সাসেক প্রকল্পে পৈত্রিক সম্পত্তি অধিগ্রহণ হওয়ার পর ৮ ধারার নোটিশ পেয়েও ক্ষতিপূরণের টাকা না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন বগুড়া শেরপুর ছোনকা এলাকার দরিদ্র সিএনজি চালক আবুল হোসেন। নুন আনতে পান্তা ফুরানোর সংসারে একদিন যখন সিএনজি নিয়ে না বেরোলে ভাত জোটেনা আবুল হোসেনের তখন ২০১৯ সাল থেকে বগুড়া ভূমি অধিগ্রহণ শাখা থেকে শুরু করে সরকারি দপ্তরের দরজায় দরজায় ঘুরে যাচ্ছেন হতভাগা আবুল হোসেন।
অশ্রুসিক্ত নয়নে আবুল অভিযোগ করে বলেন, তার অংশ হতে অধিগ্রহণ হওয়া সাড়ে ১৯ শতক জায়গার বিপরীতে তার পাওয়ার কথা ছিলো প্রায় ৩১ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকা। কিন্তু এই টাকা প্রদানে তৎকালীন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও পেশকার নিজে তার কাছে ১৬ লাখ টাকা ঘুষ দাবি করেছিলেন। সহায় সম্বল সবকিছু বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে রাজিও হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাতে মন গলেনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
আবুলের কাছে থাকা সকল সরকারি নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সবের শেখ ও আবুল হোসেনের দাদা নুরুল ইসলাম শেখ এর মালিকানাধীন শেরপুর ছোনকা মৌজায় ৯৬১ ও ৯৬৪ দাগে মোট জমি ছিলো ৪৩ শতক। এর মাঝে ১৯৯১ সালে সবের শেখ নিজেই আফসার আলীর কাছে বিক্রি করেন ১৬ শতক জমি। যা তিনি পরে সাইফুল ইসলামের কাছে বিক্রি করে। যার মাধ্যমে উক্ত জমিতে সবেরের অবশিষ্ট থাকে সাড়ে পাঁচ শতক জমি এবং নুরুল ইসলাম শেখ ওরফে নারু শেখের থাকে সাড়ে ২১ শতক জমি। আবুল জানায়, সবেরের ছয় সন্তান এবং তার দাদা নুরুল ইসলামের তিন সন্তান যার মাঝে আবুল হোসেনের বাবা আব্দুর রহমান ছিলেন সবার বড়। তবে জমি নিয়ে বিরম্বনার সূত্রপাত হয় ১৯৯২ সালে। সবের শেখ বেচে থাকা অবস্থায় পুনরায় ৬ সন্তানের মাঝে তার এক সন্তান মহির উদ্দিন শেখ কে সবের ৪০ শতক জমি হেবা দলিল করে দেন। যা মহির পুনরায় বিক্রি করেন গিয়াস উদ্দিন ও ফরিদা ইয়াসমিনের কাছে। যা পরবর্তীতে কিনে নেন আসাদ নামের এক ব্যক্তি। পরবর্তীতে ২০০৫ সালে পুরো চল্লিশ শতক জমি আসাদ পুনরায় বিক্রি করেন তন্ময় কুমার বর্মনের কাছে। অথচ সবের শেখের জমি ছিল মাত্র সাড়ে পাঁচ শতক। এদিকে ২০১৭ সালে সাসেক এই দুই দাগ থেকে মোট ৩৩ শতক জমি অধিগ্রহণ করে।
পরবর্তীতে অধিগ্রহণকৃত জমির ক্ষতিপূরণ হিসেবে জমির মালিক হিসেবে গত ২৬/৮/২০১৯ সালে ৮ ধারার নোটিশও পান আবুল হোসেন। তবে নোটিশে যুক্ত হয় তন্ময় কুমার বর্মনের নাম। ভুক্তভোগী আবুলের অভিযোগ, ৮ ধারার নোটিশ পাওয়ার পরও শুধুমাত্র তৎকালীন এডিসি ও পেশকারের দাবিকৃত ঘুষের টাকা না দেয়ায় তাকে না জানিয়েই আফসার আলীর সূত্র থেকে প্রাপ্ত জমির মালিকদের ৮ শতক বাদ দিয়ে মোট ২৫ শতকের টাকা দেয়া হয়েছে তন্ময় কুমার বর্মণকে। যা পুরোটায় দুর্নীতি ও সেচ্ছাচারিতার সামিল। আবুল বলেন, তন্ময় এই দুই দাগে জমি পেলেও পাবে মাত্র সাড়ে ৫ শতক আর বাকি সাড়ে ১৯ শতক এর টাকা মূল হকদার তিনি। অথচ ৮ শতকের ক্ষতিপূরণ হিসেবে সাইফুল ইসলামকে ১৩ লক্ষ ৭২ হাজার ৭৭৯ টাকা আর বাকি ২৫ শতকের ক্ষতিপূরণ বাবদ তন্ময় কুমার বর্মনকে একাই প্রদান করা হয় ৪০ লক্ষ ৪৬ হাজার ৫১ টাকা।
যার মাঝে আবুল হোসেনেরই পাওয়ার কথা ছিল ৩১ লক্ষ ৫৫ হাজার ৯১৯ টাকা কিন্তু ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তা কর্মচারীদের যোগ সাজসে ঘুষের বিনিময়ে তা প্রদান করা হয়েছে তন্ময় কুমার বর্মন কে। পরে অসংখ্যবার ভূমি অধিগ্রহণ শাখার কর্মকর্তাদের কাছে আকুতি মিনতি করেও ন্যায়বিচার না পাওয়ার অভিযোগ করেন জীবনের সাথে সংগ্রাম করে যাওয়া এক সৈনিক আবুল হোসেন।
তবে অন্যায়ের কাছে মাথা নত করতে নারাজ আবুল হোসেন। কূলকিনারা না পেয়ে অবশেষে ২০২২ সালে রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তরে করেছেন আপিল মামলা। সর্বশেষ সেখান থেকে বগুড়া ভূমি অধিগ্রহণ শাখায় উক্ত মামলার সার্বিক অবস্থা জানতে চেয়ে প্রতিবেদনও চাওয়া হয়েছে।
এদিকে ছোনকা সেই জমি সরজমিন পরিদর্শনে গেলে স্থানীয়রা জানান, আবুল হোসেন সিএনজি চালক হলেও স্বভাবে অত্যন্ত সহজ সরল। বাপ দাদার এক সময় অনেক জমি জমা থাকলেও ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আবুল হোসেন এখনো ভাড়া বাড়িতে থাকেন। ছোনকা মৌজার এই জমিটি তার এটি স্থানীয়রা অনেক বছর থেকেই জানেন। অধিগ্রহণ হওয়ার পরেও জমির বাকি অংশে এখনো রয়েছে আবুল হোসেনের দখল, রয়েছে আবুলের রোপন করা গাছ গাছপালাও।
এদিকে আবুল হোসেনের সাথে ঘটা এই দুর্নীতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বগুড়ার বর্তমান অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পিএম ইমরুল কায়েস জানান, যেহেতু বিষয়টি এখন বিভাগীয় কমিশনার স্যারের দপ্তরে বিচারাধীন। তাই এই বিষয়ে তার মন্তব্য করার সুযোগ নেই। তবে বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তর থেকে এই ঘটনা প্রসঙ্গে তাদের কাছে একটি প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছিল তা তারা প্রদান করেছেন। বাকি সকল বিষয় প্রক্রিয়াধীন।





