নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। এক সময় বিএনপি’র কেন্দ্রীয় নেতা থাকলেও নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন আগে পদত্যাগ করে গঠন করেন বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন। এই দল নিয়ে পরবর্তীতে যোগ দেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে। আর মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন কারণে সরকারের ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেন তিনি। বিশেষ করে জামায়াত নেতা নিজামী-সাঈদীদের বিরুদ্ধে মামলা করে সরকারের গুডবুকে চলে আসেন তিনি। পুরস্কার হিসেবে ফটিকছড়ি থেকে পরবর্তী দুইটি জাতীয় নির্বাচনে মহাজোটের টিকিটে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও এই আসন থেকে তিনিই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের প্রার্থী হচ্ছেন- এটা ছিল অনেকটা নিশ্চিত। এরইমধ্যে গত সোমবার নিজের নির্বাচনী এলাকার একটা অনুষ্ঠানে সরকারের বিষোদ্গার করে বক্তব্য দিয়েছেন। আর এই বক্তব্য নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। সোমবার রাতে ফটিকছড়িতে শাহসূফী সৈয়দ শফিউল বশর (ক.) মাইজভাণ্ডারীর খোশরোজ শরীফ উপলক্ষে আয়োজিত ওয়াজ ও দোয়া মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তব্যে নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, ‘আমার মুখ খোলাবেন না।
মুখ খুললে অসুবিধা হয়ে যাবে। আমি আপনাদের সঙ্গে (আওয়ামী লীগ) আছি, আমাকে সাইজ করার চেষ্টা করলে নিজেরাই সাইজ হয়ে যাবেন। ওরা এখনো নজিবুল বশর কি তা চিনে নাই। আমার জন্য অনেকে কথা বলবে। বিএনপিকে তো ঘরে ঢুকানো সম্ভব, কিন্তু নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীকে না। তিনি আরও বলেন, আমার সিট আমি ঠিক করি। সরকারও জানে। কওমি’র সঙ্গে সরকারের গণ্ডগোল, আমি সরকারকে সহযোগিতা করেছি। আগামী নির্বাচনেও আমি এখান থেকে এমপি নির্বাচিত হবো। আমি ভেসে আসি নাই।
মাইজভাণ্ডারের দিকে যারাই অসৎ উদ্দেশ্যে হাত দিয়েছে তাদের হাত পুড়ে গেছে। হঠাৎ করে সরকারের বিপক্ষে ভাণ্ডারীর এমন বক্তব্য রাজনৈতিক মহলে আলোচনার ঝড় উঠেছে। প্রধানমন্ত্রীর অতি কাছের মানুষ বলে পরিচিত ভাণ্ডারী কেন হঠাৎ ক্ষেপেছেন সেটি নিয়ে চলছে জোরেশোরে আলোচনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে নানা কথাবার্তা। জানা যায়, প্রয়াত ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ আব্দুল্লাহ’র মৃত্যুর পর নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীই এই মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী হতে যাচ্ছেন- সেটি অনেকটা নিশ্চিত ছিলেন অনেকে। তবে রহস্যজনক কারণে তাকে মন্ত্রিত্ব দেননি প্রধানমন্ত্রী। মূলত এই বিষয়ে মনঃক্ষুণ্ন ছিলেন ভাণ্ডারী। এরমধ্যে গত ১৯শে ফেব্রুয়ারি বিকালে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় ঢাকা-১ কমিশনের সহকারী পরিচালক মো. সাইফুল ইসলাম বাদী হয়ে নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর দুই ছেলে সৈয়দ তৈয়েবুল বশর মাইজভাণ্ডারী ও সৈয়দ আফতাবুল বশর মাইজভাণ্ডারীসহ ১৪ জনের নামে একটি মামলার আবেদন করেন। এতে বিবাদীদের বিরুদ্ধে ‘প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট’র ৩৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। মূলত এই এই মামলা ভাণ্ডারীর ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। দুদকের সেই মামলার আবেদনে বলা হয়, প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের কয়েকজন কর্মকর্তাসহ অন্যরা অসৎ উদ্দেশ্যে ও পরস্পর যোগসাজশে অপরাধমূলক বিশ্বাস ভঙ্গের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি থেকে ৩৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ মঞ্জুর ও বিতরণ করে। এরপর অভিযোগ সংশ্লিষ্টরা ওই অর্থ স্থানান্তর, রূপান্তর ও হস্তান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন।
দুদকের এই মামলায় ভাণ্ডারীর দুই পুত্রসহ অন্য আসামিরা হলেন-প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান কে এম খালেদ, ছেলে কে এম রাকিব হোসেন, আত্মীয় খন্দকার মো. মোস্তাহিদ, পরিচালক মুসলিমা শিরিন, জেড এম কায়সার, মো. অলিউজ্জামান, এম শাহাদত হোসেন কিরন, সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট গুলশান আরা হাফিজ ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট তাজরিয়ান হক, সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদ খান, সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আহসান কবির খান, সাবেক এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. রেজাউল হক। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯ ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ৪ (২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এদিকে ছেলেদের বিরুদ্ধে মামলা ও সরকারের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার নিয়ে মানবজমিনের সঙ্গে কথা হয় নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর। এসময় তিনি তার বিরুদ্ধে একটি চক্র ষড়যন্ত্র করছেন বলে দাবি করেন। এ ছাড়া দুদকের মামলাটি সম্পূর্ণ বানোয়াট বলে অভিহিত করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার পাশাপাশি এই বিষয়ে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করবেন বলেও জানান। নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী বলেন, এরা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। কাল্পনিক কাহিনী দিয়ে আমার মানসম্মান নষ্ট করার চেষ্টা করছে।
আমিও বিষয়টি দেখে নিবো। ঢাকায় গিয়ে সাংবাদিকদের ডাকবো। সব বিষয় খোলাসা করবো। এরা আমাকে উলঙ্গ করছে তো, আমিও এটা দেখে নিবো। আমি নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী। আমি এখনো সরকারের অংশ। তরিকত চেয়ারম্যান বলেন, দুদকের প্রতিবেদনে ৩৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা ঋণ আত্মসাতের কথা বলা হয়েছে। আর এই টাকার বিপরীতে যে ৬৫ কোটি টাকা জমা দেয়া হয়েছে, সেটি তারা লুকিয়েছে। ইনকাম ট্যাক্সের বিষয়টি আসেনি। অনেক কিছু আসেনি। এটা ষড়যন্ত্রের একটি অংশ। আমি সব বিষয়ে মিডিয়াকে বলবো। এদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিবো। এদিকে ভাণ্ডারীর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ফটিকছড়ি থেকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী ও চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এটিএম পেয়ারুল ইসলাম বলেন, মামলা করেছে দুদক। এটা একটা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। এখানে সরকারকে দোষারোপের বিষয়টি আমার বোধগম্য নয়। ভাণ্ডারী সাহেব এখনো মহাজোটের শরিক দলের নেতা। আর এখন উনি কেন এমন বক্তব্য দিয়েছেন সেটি উনিই ভালো বলতে পারবেন। প্রসঙ্গত, রাজনীতিতে রহস্যময় পুরুষ বলে পরিচিত সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর পরিবারের সবাই তরিকতভিত্তিক সংগঠনে জড়িত থাকলেও তিনি শুরুতেই যুক্ত হন আওয়ামী লীগে। পরে যোগ দেন বিএনপিতে। তিনি আওয়ামী লীগ থেকে একবার, বিএনপি থেকে একবার ও তরিকত ফেডারেশনের প্রার্থী হয়ে টানা দুইবার ফটিকছড়ি থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন।