সংবাদ প্রকাশের জেরে দৈনিক প্রথম আলোর সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে নিয়ে দিনভর নাটকীয়তা হয়েছে গতকাল। ভোরে সাভারের বাসা থেকে সিআইডি পরিচয়ে তাকে তুলে আনা হয়। ওই রাতেই তেজগাঁও থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা রেকর্ড করা হয়। গতকাল দুপুরের পর মামলার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। ভোর রাতে তুলে নেয়া হলেও গত রাত ৮টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত শামসুজ্জামানকে আটক বা গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি। তিনি কোথায় আছেন এ বিষয়েও কেউ কোনো বক্তব্য দেননি। তাকে আটক বা গ্রেপ্তার দেখানো না হলেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও এ নিয়ে বক্তব্য রাখেন। শামসুজ্জামানকে তুলে নেয়ার বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ করেছেন অনেকে। তাকে তুলে নেয়ার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে সম্পাদক পরিষদ।
শামসুজ্জামান হলিআর্টিজান হামলায় নিহত পুলিশের সহকারী কমিশনার মো. রবিউল করিমের ছোট ভাই।
স্বাধীনতা জাতীয় দিবসের দিনে প্রথম আলো অনলাইনে একটি সংবাদ প্রকাশের জেরে গতকাল তেজগাঁও থানায় শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেছেন যুবলীগ নেতা সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া। মামলার নম্বর-৫৮। মামলায় প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামস্কে ১ নম্বর এবং অজ্ঞাত আরও অনেককে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়, মঙ্গলবার রাত ১টা ৩২ মিনিটে তেজগাঁও থানায় শামসের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ দায়ের করেন ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া। এটি রাত সোয়া ২টায় মামলা হিসেবে রুজু হয়। মামলার নথি অনুযায়ী, দৈনিক প্রথম আলোতে মিথ্যা ও বানোয়াট প্রতিবেদন প্রকাশের অভিযোগ আনা হয়েছে শামসুজ্জামান শামসের বিরুদ্ধে।
যেভাবে তুলে নেয়া হয়: স্থানীয় সাংবাদিক প্রত্যক্ষদর্শী এবং পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, ভোর ৪টার দিকে ৩টি গাড়ি জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের পেছনে অবস্থিত শামসুজ্জামানের আমবাগানের বাসার সামনে যান। ৩টি গাড়িতে মোট ১৬ জন ব্যক্তি শামসুজ্জামানের বাসার সামনে নামেন। তাদের মধ্যে ৭-৮ জন বাসায় প্রবেশ করেন। একজন শামসুজ্জামানের থাকার কক্ষ তল্লাশি করে তার ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ, দুইটি মোবাইলফোন ও একটি পোর্টেবল হার্ডডিস্ক নিয়ে যায়। বাসায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট অবস্থান করার পর তাকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় যান তারা। বটতলার নুরজাহান হোটেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন, একজন নিরাপত্তা প্রহরী ও শামসুজ্জামানসহ মোট ১৯ জন সেহরি খান। ভোর পৌঁনে ৫টার দিকে বটতলা থেকে তারা আবার শামসুজ্জামানের বাসায় যান। দ্বিতীয়বার বাসায় যাওয়ার সময় আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রাজু সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এ সময় শামসুজ্জামানের বাসায় ছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম। তিনি জানান, বাসায় এসে তারা জব্দ করা মালামালের তালিকা করেন। শামসুজ্জামানকে জামাকাপড় নিতে বলা হয়। এ সময় কক্ষের ভেতরে দাঁড় করিয়ে তার ছবি তোলা হয়। ৫-৭ মিনিটের মধ্যে আবার তারা বের হয়ে যান। বাসা তল্লাশির সময় দু’বারই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন উপস্থিত ছিলেন। তুলে নেয়ার সময় ওই বাসার মালিককে ডাকেন পুলিশের এক কর্মকর্তা। পুলিশ তাকে জানায়, শামসুজ্জামানের করা একটি প্রতিবেদনের বিষয়ে রাষ্ট্রের আপত্তি আছে। তাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে নেয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে শামসের ভাবী পুলিশের প্রয়াত সহকারী কমিশনার রবিউলের স্ত্রী উম্মে ইসলাম বলেন, কি কারণে তাকে নিয়ে গেছে, কি তার অপরাধ কিছুই জানি না। গত মঙ্গলবারও শামসের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তখনো এ বিষয়ে শামস আমাকে কিছু বলেনি। শামস এর আগে প্রথম আলোতে কাজ করার কিছুদিন পর চাকরি ছেড়ে দেয়। এরপর ব্যাংকে চাকরি নেয়। এরপর পুনরায় প্রথম আলোতে কাজ শুরু করেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শামসকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে ওর বৃদ্ধা মা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। নিজস্ব একটি সূত্রে জানতে পেরেছি শামসকে সিআইডি কার্যালয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু ওর সঙ্গে এখনো কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। তিনি বলেন, যার ভাই দেশের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। যে পরিবারটিকে এত মানুষ সম্মান দেখালো সেটার মূল্যায়নটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এভাবে করবেন ভাবতে পারিনি। শামস অপরাধী হলে তাকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় শাস্তি নিশ্চিত করতেন। কিন্তু এভাবে রাতের আঁধারে একজন ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া এটা কি ধরনের আচরণ। শহীদ রবিউলের পরিবারকে তারা কীভাবে মূল্যায়ন করলেন। তিনি তো বড় কোনো অন্যায় করেননি। খেটে খাওয়া একজন মানুষের কথা তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে তার কর্মক্ষেত্র যথাযথ প্রক্রিয়া মেনেই নিশ্চয় নিউজ এবং ছবিটি প্রকাশ করেছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন বলেন, আমি আগে বিষয়টি জানতাম না। রাত দেড়টার সময় পুলিশের পক্ষ থেকে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। শামসুজ্জামানের ভাবী আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা। সেই পরিচয় দিয়ে তারা আমাকে শামসুজ্জামানের বাসায় নিয়ে যান। আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম কামরুজ্জামান বলেন, তিনি এ বিষয়ে এখনো কিছু জানেন না। তারা কাউকে গ্রেপ্তার করেননি। শামসকে তুলে নেয়া প্রসঙ্গে আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) রাজু ম-ল জানান, ঢাকা থেকে আসা সিআইডির একটি দল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছে আমবাগান এলাকার ভাড়া বাসা থেকে শামসুজ্জামানকে আটক করেছে। সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান মানবজমিনকে বলেন, প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসকে সিআইডি’র কোন টিম এনেছেন এ বিষয়ে আমার জানা নেই।
ওদিকে শামসুজ্জামানের বিষয়ে সচিবালয়ে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, আইন নিজস্ব গতিতে চলে। আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রসহ সবই চলে। কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হয়ে বিচার চায়, কিংবা সংক্ষুব্ধ হয়ে থানায় মামলা করে, সেই অনুযায়ী পুলিশ ব্যবস্থা নিতেই পারে। আমি যতটুকু জানি, একটা মামলা রুজু হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আপনারা যেভাবে বলছেন, আমি পরিষ্কার করে এর উত্তর দিতে পারছি না। কারণ, আমার কাছে সব রিপোর্টগুলো এখনো আসেনি। আমি বিভিন্নভাবে জেনেছি এই মামলাকে কেন্দ্র করে, খুব সম্ভবত কিছু একটা ঘটনা ঘটেছে। আমি এখনো পরিষ্কার নই। আমি পরিষ্কার হয়ে আপনাদের জানাতে পারবো। তবে প্রথম আলোর সাংবাদিক সাহেব যে সংবাদ করেছেন, এটা সঠিক ছিল না। আমি মনে করি, স্বাধীনতা দিবসে আমরা এতদূর এগোনোর পরে এই ধরনের একটা ভুয়া নিউজ যদি কেউ দেয়, যে কেউ সংক্ষুব্ধ হতে পারেন। রাষ্ট্রের আপত্তি আছে বলে শামসকে তুলে নেয়ার সময় বলা হয়েছে উল্লেখ করলে এ বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রের আপত্তি নয়। একটা মামলা হয়েছে।
সম্পাদক পরিষদের উদ্বেগ প্রকাশ: প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮/এর ২৫(২), ২৬(২), ২৯(১), ৩১(২) এবং ৩৫(২) ধারায় মামলা ও আটকে সম্পাদক পরিষদ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। গতকাল পরিষদের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ ইতিমধ্যেই সাংবাদিকতাসহ বাকস্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধিচর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। সাংবাদিক, আইনবিদ, মানবাধিকারকর্মী, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ সরকারের একাধিক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের নিকট হতেও আইনটির পরিবর্তন, পরিমার্জন, বিয়োজন ও সংযোজনের বিষয়ে নানা ধরনের পরামর্শ, সুপারিশ ও উদ্বেগ প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে।
আইনটি তৈরির সময় থেকেই সম্পাদক পরিষদ এবং সাংবাদিকরা এ আইনের বিষয়ে উদ্বেগ ও আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। আইনমন্ত্রী এই আইনের বিভিন্ন রকম অপব্যবহার এবং সেই প্রেক্ষিতে আইনটি সংশোধনের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও এই আইনের মাধ্যমে সংবাদকর্মী ও মুক্ত মতপ্রকাশকারী ব্যক্তিরা ক্রমাগতভাবে নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
কোনো সংবাদে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে তিনি প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ ও মামলা করতে পারেন। কিন্তু সেটি না করে সরাসরি ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা দায়ের হচ্ছে। তাই সাংবাদিকতার স্বাধীন ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দ্রুত সংশোধনসহ সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসসহ সকল সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে পরিষদ। একইসঙ্গে এই আইনে কেউ গ্রেপ্তার বা আটক থাকলে অবিলম্বে তার মুক্তি দাবি করা হয় পরিষদ সভাপতি মাহফুজ আনাম ও সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে।
ওদিকে প্রথম আলোর সাভার প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে তার বাসা থেকে সিআইডির পরিচয়ে তুলে নেয়ার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এডিটরস গিল্ড অব বাংলাদেশ। গতকাল বিকালে জারি করা এক বিবৃতিতে এডিটরস গিল্ড স্পষ্ট করে বলে, সাংবাদিকদের কোনোভাবেই গ্রেপ্তার, হয়রানি বা নির্যাতন করা যাবে না। গণমাধ্যমের জন্য মুক্ত ও স্বাধীন কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে এডিটরস গিল্ড বলে, প্রথম আলো যদি সাংবাদিকতার নীতিবিরুদ্ধ কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাহলে সংক্ষুব্ধ পক্ষ বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে সাহায্য চাইতে পারে। বিষয়টি প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে নিষ্পত্তির আহ্বান জানিয়েছে এডিটর্স গিল্ড।