ঢাকাবৃহস্পতিবার , ৯ মার্চ ২০২৩
  • অন্যান্য

পরপর বিস্ফোরণ,আতঙ্কের মুখে শহরবাসী

অনলাইন ডেস্ক
মার্চ ৯, ২০২৩ ৭:১৫ পূর্বাহ্ণ । ১৩৯ জন
বিস্ফোরণ

গত মঙ্গলবার বিকেল পৌনে ৫টা। রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা গুলিস্তান থেকে সদরঘাট যাওয়ার সড়ক। দুই পাশের ভবনগুলোর নিচতলায় অসংখ্য মার্কেট-দোকানপাটে শেষ সময়ের ব্যস্ততা। সড়কে নিত্যদিনের জট। শবে বরাতের রাতে ঘরে ফেরার তাড়া পথচারীদের। এর মধ্যে সিদ্দিকবাজারের কুইন মার্কেটের স্যানিটারির দোকানগুলোতে ঢুঁ মারছিলেন একাধিক ক্রেতা। ফুটপাতে গা এলিয়ে বসে ছিলেন মালামাল টানা ভ্যানওয়ালারা। কেউবা মালামাল তুলছিলেন নিজ নিজ ভ্যানে। হঠাৎ প্রলয়ংকরী এক শব্দ। আচমকা বিস্ফোরণ। ধোঁয়ার কুণ্ডলী। চিৎকার-চেঁচামেচি। ইট-কংক্রিট-কাচের আঘাতে আহতরা রাস্তায়। প্রথমে ভূমিকম্প বা ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণ মনে করেছিলেন অনেকেই। কয়েক মুহূর্ত পর সংবিৎ ফিরে পান আশপাশের লোকজন। দেখেন কুইন মার্কেটের সামনে যেন এক মৃত্যুপুরী তৈরি হয়েছে।

গত শনিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে একটি অক্সিজেন প্ল্যান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে ছয়জন নিহত হন। এর এক দিন পরই ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকায় শিরিন ম্যানশন নামে একটি বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ গ্যাস বিস্ফোরণে তিনজন নিহত ও ১৪ জন আহত হন। এর তিন দিনের মাথায় কেঁপে উঠল রাজধানীর অন্যতম ব্যস্ততম এলাকা গুলিস্তানসংলগ্ন সিদ্দিকবাজার। কুইন মার্কেট নামে একটি সাততলা ভবনের বেজমেন্টে হঠাৎ বিস্ফোরণে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে।

পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও হাসপাতাল সূত্র বলছে, ভয়াবহ ও আচমকা এই বিস্ফোরণে গতকাল পর্যন্ত মারা গেছেন ২০ জন। আহত হয়েছেন শতাধিক মানুষ। নিহতের তালিকায় রয়েছেন দোকানমালিক থেকে কর্মচারী ও পথচারীরাও। মঙ্গলবার রাত থেকেই নিহতদের পরিচয় শনাক্তের পর স্বজনদের কাছে মরদেহ হস্তান্তর শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ৫০ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, কুইন মার্কেটের সাততলা ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডের কোনো একটি বদ্ধ কক্ষ গ্যাস চেম্বার হয়েছিল। সেখানে আগুনের স্পর্শ বা বৈদ্যুতিক স্পার্ক থেকে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটে। তবে কোথাকার গ্যাস সেখানে জমা হয়েছিল, তা সুনির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি কেউ।

এদিকে পরপর তিনটি বিস্ফোরণের কারণে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার মানুষের মধ্যে বিস্ফোরণ-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। এসব বিস্ফোরণ স্বাভাবিক নাকি অস্বাভাবিক, নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা, দুর্ঘটনা হলে দায় কার, তা নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। প্রশ্ন উঠেছে দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা নিয়েও।

বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, ঢাকার স্যুয়ারেজ লাইন, তিতাসের গ্যাস লাইনসহ এসির গ্যাস বিপজ্জনক এক অবস্থা তৈরি করেছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অবহেলার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের অসচেতনতাকেও দায়ী করছেন তারা। আবাসিক ভবনকে বাণিজ্যিক ভবন তৈরি, নকশা না মানা, যথাযথ বাতাসপ্রবাহ বা ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক ভবন যেন মৃত্যুকূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদিকে গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, রাজধানীর সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের কারণ জানতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হলে তারা সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন কেন বিস্ফোরণ হয়েছে। তিনি জানান, বিস্ফোরণের পর ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ ইমারতে পরিণত হয়েছে।

সায়েন্স ল্যাব এলাকার একটি বাণিজ্যিক ভবনে বিস্ফোরণের তিন দিনের মাথায় আবারও একটি বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সব ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা এর কারণ অনুসন্ধানে কাজ শুরু করেছেন। বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকেই ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার তৎপরতার সঙ্গে পুলিশের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, র‌্যাবের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট, সেনাবাহিনীর বিস্ফোরণ বিশেষজ্ঞ দল, সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিটসহ সব সংস্থাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেছে। যদিও এখন পর্যন্ত সিদ্দিকবাজারে ভবন বিস্ফোরণে কোনো নাশকতার প্রমাণ পায়নি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী জানান, প্রাথমিকভাবে সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণে কোনো আইইডির (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) উপকরণ পাওয়া যায়নি। এমনকি কোনো কেমিক্যাল বিস্ফোরণের অস্তিত্ব নেই।

তাদের ধারণা, ভবনের বেজমেন্টের বদ্ধ কোনো কক্ষে গ্যাস জমে সেটি ‘গ্যাস চেম্বারে’ পরিণত হয়েছিল। সেখানে যেকোনো উপায়ে স্পার্ক (আগুনের স্ফুলিঙ্গ) হওয়ার পরই সেটি ভয়াবহ শক্তি নিয়ে বিস্ফোরিত হয়। গ্যাসের লাইন বা স্যুয়ারেজের লাইন থেকে মিথেন গ্যাস লিকেজ হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে তা শক্তিশালী কার্বন মনোঅক্সাইড তৈরি হয়ে থাকতে পারে। এ ছাড়া ভবনের নিচে সেফটিক ট্যাংক, দুই ভবনের মাঝখানে একটি পানির ট্যাংক থেকে কোনো গ্যাস নির্গত হয়েছে কি না তাও পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। এসব পরীক্ষার জন্য তারা বেজমেন্ট থেকে পানিসহ অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহ করেছে। বাতাসে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতিও পরীক্ষা চলছে।

এডিসি রহমত উল্লাহ চৌধুরী জানান, আইইডি বিস্ফোরিত হলে সার্কিটের অস্তিত্ব পাওয়া যেত। এ ছাড়া অন্য কোনো বিস্ফোরক ব্যবহার হলে ধোঁয়া কালো হয়। সেখানে এ রকম কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়া লাশের আঘাতের ধরনও দেখে এটি গ্যাসের বিস্ফোরণ বলে মনে হয়েছে।

র‌্যাবের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের প্রধান মেজর মশিউর রহমান বলেছেন, ‘আমরা তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এবং রাজউকের বিশেষজ্ঞরাও সমন্বয় করে কাজ করছি। প্রাথমিকভাবে পেয়েছি ভবনের বিস্ফোরণ বেজমেন্ট থেকে হয়েছে। এটি স্বাভাবিক কোনো বিস্ফোরণ নয়। এটি একটি শক্তিশালী বিস্ফোরণ। এটি গ্যাস লিকেজের কারণে হয়ে থাকতে পারে কিংবা অন্য কোনোভাবে বিস্ফোরকের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। এ ঘটনা এসি থেকে ঘটার আশঙ্কা খুবই কম।

সরেজমিন বিস্ফোরণের পর পরই সিদ্দিকবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গুলিস্তান থেকে বিআরটিসির বাস কাউন্টার পেরিয়ে কয়েক শ গজ পরই সিদ্দিকবাজারের সাততলা কুইন ভবন। এই ভবনের বেজমেন্টেই বিস্ফোরণ হয়। বিস্ফোরণে ভবনের নিচতলা ও দোতলায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ওপরের তলাগুলোর জানালার গ্লাস ভেঙে পড়েছে। পাশের আরেকটি পাঁচতলা ভবনের নিচতলার একটি স্যানিটারি দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশি। এই ভবনের দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত ব্র্যাক ব্যাংকের কার্যালয়। ওপরের তলাগুলোর সব গ্লাস ভেঙে পড়েছে। সামনে থাকা ভ্যান-রিকশাসহ সব যানবাহন দুমড়ে-মুচড়ে গেছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিস্ফোরণের সময় সাভার পরিবহনের একটি বাস ওই ভবনের সামনেই যানজটে আটকে ছিল। বিস্ফোরণের কারণে বাসের জানালার গ্লাস ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। চালক-হেলপারসহ প্রায় সব যাত্রীই আহত হন। এ ছাড়া সড়কে চলাচলরত পথচারীরাও হতাহত হন আচমকা এই বিস্ফোরণে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একাধিক ইউনিট উদ্ধার তৎপরতা চালাচ্ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পুরো এলাকা কর্ডন করে রাখেন। অসংখ্য উৎসুক মানুষের উপস্থিতি। স্বজন হারানো ব্যক্তিরা নিজ নিজ স্বজনদের খুঁজে ফিরছিলেন। ঘটনার পর পরই আশপাশের লোকজন এগিয়ে গিয়ে আহতদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো শুরু করে।

এদিকে দুর্ঘটনার পর একে একে ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিট একযোগে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করলেও ভবনটির পিলার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভেতরের কংক্রিট কেটে উদ্ধার তৎপরতা চালাতে পারছিলেন না ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। পরে তারা সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞ দল ও বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলের সহযোগিতা কামনা করেন। মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে উদ্ধার অভিযান স্থগিত রাখা হয়। গতকাল সকাল ৯টার দিকে দ্বিতীয় দফায় উদ্ধার অভিযানে নতুন করে বেজমেন্ট থেকে দুজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগীয় উপপরিচালক দিনমণি শর্মা জানিয়েছেন, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। এই অবস্থায় ভবনের ভূগর্ভস্থ স্থানে উদ্ধারকাজ চালানো সম্ভব নয়। তাই বুয়েটের বিশেষজ্ঞ দলের মতামতের ভিত্তিতে উদ্ধারকাজ চালানো হচ্ছে। দ্বিতীয় দিন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে উদ্ধার অভিযান সাময়িকভাবে স্থগিত রয়েছে।

মঙ্গলবার রাতে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এটা নিছক দুর্ঘটনা। তার পরও তদন্ত চলছে। তদন্তের পর পরিপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।’

নিহত হয়েছেন যারা

সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনায় সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ২১ জন নিহত হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। নিহতরা হলেন চকবাজারের বাসিন্দা মমিনুল ইসলাম (৩৮) ও তার স্ত্রী নদী আক্তার (৩৬); বংশালের বাসিন্দা মোহাম্মদ সুমন (২১), যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা মুনসুর হোসাইন (৪০), ঢাকেশ্বরী এলাকার বাসিন্দা ইসহাক মৃধা (৩৫), আলুবাজারের ইসমাইল হোসেন (৪২), কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা রাহাত (১৮), চাঁদপুরের আলামিন (২৩), মুন্সীগঞ্জের বাসিন্দা মাইন উদ্দিন (৫০), বংশালের নাজমুল হোসেন (২৫), মানিকগঞ্জের ওবায়দুল হাসান বাবুল (৫৫), মুন্সীগঞ্জের আবু জাফর সিদ্দিক (৩৪), বংশালের আকুতি বেগম আছিয়া (৭০), বংশালের হৃদয় (২০), যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা নুরুল ইসলাম ভুইয়া (৫৫), আব্দুল হাকিম সিয়াম (১৯), যাত্রাবাড়ীর ইদ্রিস মীর (৬০), বংশালের মমিনুদ্দিন সুমন (৪৪), রবিন ও, আওলাদ হোসেন মুসা (৩৭) ও অজ্ঞাত একজন।

ঢাকার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মুমিনুর রহমান রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসে সাংবাদিকদের জানান, আপাতত নিহতের স্বজনদের দেয়া হবে ৫০ হাজার টাকা, গুরুতর আহতদের দেয়া হবে ২৫ হাজার টাকা আর অল্প আহতদের দেয়া হবে ১৫ হাজার টাকা। যাতায়াত ও খাবারের ব্যবস্থাও জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে করা হবে।