টানা ৩ বছরের মন্দার পর ঈদ সামনে রেখে ব্যাপক প্রস্তুতি ছিল পোশাকের সবচেয়ে বড় পাইকারি মার্কেট বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের। নিজেদের গোছানো পুঁজি, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ঋণ, ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে এবার ব্যবসায় বিনিয়োগ ছিল সর্বোচ্চ। কিন্তু দেশের স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব। চোখে শুধু অন্ধকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং দোকান মালিক সমিতির হিসাবে ৫ হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
দোকান মালিক সমিতির প্রাথমিক হিসাবে ক্ষতির পরিমাণ হাজার কোটি টাকা ছাড়তে পারে। তবে প্রকৃত ক্ষতি এখনই নিরূপণ করা সম্ভব নয়। কারণ এখানে বহুমুখী ক্ষতি রয়েছে। দোকানের মালিক, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী, দিনমজুর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও দোকানের কর্মকর্তা-কর্মচারী, সারা দেশের খুচরা ব্যবসায়ী, বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদক, ফুটপাতের হকার, ব্যাংক এবং বিমা কোম্পানিসহ অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে সম্মিলিত ক্ষতির আকার বিশাল। কেউ কেউ বলছেন, এই ঘটনায় সারা দেশে পোশাক সরবরাহে ঘাটতি হবে। এদিকে অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধান, ক্ষতিগ্রস্ত চিহ্নিতকরণ এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণে ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। কমিটিকে আগামী ৩ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এদিকে অগ্নিকাণ্ডে আহতদের প্রত্যেককে ১৫ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হচ্ছে। বিমা কোম্পানি বলছে, কারও বিমা থাকলে দ্রুতই ক্ষতিপূরণ মিলবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার অপেক্ষায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
এ ব্যাপারে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, আগুনে প্রায় পাঁচ হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত। তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত দোকানিদের সহায়তায় সরকার সর্বোচ্চটুকু করবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন মঙ্গলবার বলেন, মার্কেটগুলোতে সাড়ে ৫ হাজারের মতো দোকান ছিল। সবই পুড়ে গেছে। কেউ কেউ হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষতির কথা বলছেন। কিন্তু এখনই এটি নিরূপণ করা সম্ভব নয়। কারণ এখানে বহুমুখী ক্ষতি রয়েছে। দোকানের মালিক, ব্যবসায়ী, দিনমজুর, সারা দেশের খুচরা ব্যবসায়ী, পণ্যের উৎপাদক, ফুটপাতের হকার, ব্যাংক এবং বিমা কোম্পানিসহ অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত। তিনি বলেন, এই ঘটনায় পুরো ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি থোক বরাদ্দ দাবি করছি। এই থোক বরাদ্দ দেওয়া হলে ব্যবসায়ীরা কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। বঙ্গবাজার শপিং কমপ্লেক্স দোকান মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক বিএম হাবিব অভিযোগ করেন, জমি ফাঁকা করার জন্য অগ্নিসংযোগ বা নাশকতার ঘটনা হতে পারে। দীর্ঘদিন একটি মহল অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। মার্কেটের ভেতরে আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য গ্যাস ছিল। কিন্তু সকালবেলা হওয়ায় ব্যবহার করা যায়নি।
ব্যবসায়ীরা বলেন, করোনার কারণে টানা দুই বছর ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির ছিল। এরপর ২০২২ সালে অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা নেমে আসে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের প্রত্যাশা ছিল এবার ঈদে বেচাকেনা বাড়বে। তাতে আগের ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে টিকে থাকা যাবে। এজন্য পুঁজির সর্বোচ্চ বিনিয়োগ ছিল এখানে। শুধু ব্যবসায়ী নয়, দোকান মালিক, লাখো কর্মচারীর ঈদের বেতন-বোনাস সবকিছুই এর সঙ্গে জড়িত। স্মরণকালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ছাই হয়ে যায় লাখো মানুষের স্বপ্ন। শুকিয়ে গেছে চোখের জল।
তবে এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, ৮টি মার্কেটের অন্তত ৫ হাজার দোকান আগুনে ছাই হয়েছে। একেকটি দোকানে ৫ লাখ থেকে ৫ কোটি টাকার পণ্য ছিল। মার্কেটগুলো হলো-বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স, আদর্শ মার্কেট, গুলিস্তান ও বঙ্গবাজার মার্কেট, এনেস্কো মার্কেট, ইসলামিয়া, বরিশাল প্লাজা ও মহানগর কমপ্লেক্স মার্কেট। বেশিরভাগ পুড়ে যাওয়া দোকানগুলোতে প্যান্ট, শার্ট, গেঞ্জি, থ্রিপিস ও শাড়ি ছিল। আর ব্যবসায়ীদের একটি অংশের দাবি সবমিলিয়ে তাদের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সহায়-সম্বল হারানোর পাশাপাশি অনেকে বিভিন্ন ব্যাংকে বড় অঙ্কের টাকা ঋণগ্রস্ত।
সরেজমিন জানা গেছে, ঈদ সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। কিন্তু মুহূর্তেই সব স্বপ্ন ধুলোয় মিশে যায়। ৮টি মার্কেটের মধ্যে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ও মহানগর কমপ্লেক্স সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে তৈরি। ওই মার্কেটগুলোর সব দোকান পুড়ে ছাই হয়েছে। এনেস্কো ভবনের তিন, চার, পাঁচ, ছয় ও সাততলার সব দোকান ক্ষতিগ্রস্ত। তাছাড়া ইসলামিয়া মার্কেট ও বরিশাল প্লাজার কয়েকটি ফ্লোর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এক্সেসরিজ ওয়ার্ল্ডের মালিক নজরুল ইসলাম বলেন, বঙ্গমার্কেটের ৩১ থেকে ৩৭ নম্বর পর্যন্ত ৭টি দোকান আমার। এখানে ২ কোটি টাকার পণ্য ছিল। নগদ ছিল ১৫ লাখ টাকা। কিন্তু সবশেষ। তিনি বলেন, আমাদের দোকানে ৪০ জন লোক কাজ করত। কিন্তু এখন আমি পথের ফকির।
এনেস্কো মার্কেটের আবু সাঈদ নামে একজন ব্যবসায়ী জানান, কিছুদিন আগে মার্কেটের তৃতীয়তলায় একটি দোকান নেন তিনি। ঈদ মৌসুমে ব্যবসার জন্য ৫ লাখ টাকা ঋণ নেন তিনি। স্বপ্ন ছিল, এই ব্যবসা দিয়েই ঋণের টাকা পরিশোধ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। কিন্তু শুরুর আগেই সব শেষ। প্রতিবেদকের সামনে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। সাইফুল নামে একজন ব্যবসায়ী যুগান্তরকে বলেন, মহানগর কমপ্লেক্সের দ্বিতীয়তলায় একটি প্যান্টের দোকান তার। ঈদের জন্য ৩০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে মালামাল উঠিয়েছেন। কিন্তু শুধুই স্মৃতি। বঙ্গবাজারের এনেক্সকো টাওয়ারে রাশেদ বেডিং দোকানের ব্যবসায়ী মো. জকি বলেন, এই মার্কেটে দোকানের নম্বর রয়েছে ১২ হাজার। শুধু বঙ্গবাজার কাঠের মার্কেটে দোতলা মিলিয়ে দোকান আছে আট হাজার। ওই মার্কেট সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। ওই মার্কেটের আবু বক্কর কালেশনের মালিক মো. সিদ্দিক বলেন, খবর পেয়ে সাইনবোর্ড থেকে সাড়ে ৬টায় এসে দেখি ভয়াবহ আগুন। আমার দোকান নিচতলায়। তাই কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তিনি বলেন, কেবল বিক্রি শুরু হয়েছিল মাত্র। হাজার হাজার কোটি টাকার মালামাল নষ্ট হয়েছে। অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে, স্বজনদের কাছ থেকে ধার নিয়ে ব্যবসা করছেন। ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ সন্দেহ করছেন, এটি পরিকল্পিত নাশকতা হতে পারে।
পাইকারি দোকান নাফি গার্মেন্টের মালিক মোহাম্মদ মাসুম। বাসা শনির আখড়া। বঙ্গমার্কেটে দুটি দোকান ছিল তার। এই দুই দোকানে প্রায় ৪০ লাখ টাকার মাল ছিল। ঈদকে সামনে রেখে নিজেদের জমানো সব পুঁজি ব্যবহার, আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়া ছাড়াও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে ১২ লাখ ঋণ নেন। অগ্নিকাণ্ডে দোকানের ৭০ শতাংশ মালামাল পুড়ে গেছে। শেষ সময়ে মাত্র ৩০ শতাংশ উদ্ধার করতে পেরেছেন।
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ আছে, এটা ঠিক। তবে কী পরিমাণ ঋণ আছে সে অঙ্ক এ মুহূর্তে বলা কঠিন। নিশ্চয়ই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা যোগাযোগ করবেন, তখন ঋণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসবে। এ বিষয়ে কী ভাবছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটা তো বড় ঘটনা। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দেবে। ব্যাংকগুলো সে নির্দেশনার আলোকে কাজ করবে।
কমলাপুরের রেলওয়ে ফুটপাতে পোশাকের ব্যবসা করেন আব্দুল হান্নান ও সুমন। প্রতিদিন বঙ্গবাজারের পাইকারি মার্কেট থেকে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মাল আনেন। কিন্তু মার্কেট ধ্বংস হওয়ায় সব আশাভরসা শেষ।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স ফোরামের সভাপতি বিএম ইউসুফ আলী যুগান্তরকে বলেন, বিমা খাতের সঙ্গে এই বাজারের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। তবে কতটি দোকানের বিমা করা ছিল সুনির্দিষ্টভাবে তা বলা কঠিন। তবে সাধারণ বিমায় অনেক দোকান বিমা করা থাকতে পারে। এক্ষেত্রে যাদের বিমা ছিল তারা অবশ্যই ক্ষতিপূরণ পাবে। যত দ্রুত সম্ভব এটি পরিশোধের চেষ্টা করা হবে। তিনি বলেন, এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বিমা খাতের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। কারণ যেসব প্রতিষ্ঠানের বিমা ছিল, তাদের ব্যবসা চালু করার জন্য অন্য কোথাও যেতে হবে না।
বঙ্গবাজারের পাশে এনেক্সকো মার্কেটে টি-শার্টের দোকান ছিল শাহেদ আহমেদের। তিনি বলেন, দোকানে ১২ লাখ টাকার মতো মাল ছিল। চোখের সামনে পুড়ে গেছে সব। শাহেদ আহমেদ বলেন, সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাড়াহুড়া করে কিছুটা বের করেছি। কিন্তু বেশিরভাগ মালই ভেতরে রয়ে গেছে। একই মার্কেটের নুর আলম মাহিন বলেন, ২০০৪ সালে এই বঙ্গবাজারে এসেছি। বিভিন্ন চাকরি করার পর ২০১১ সালে জিনস প্যান্টের পাইকারি দোকান শুরু করি। অনেক কষ্টের দোকান আমার। আজ চোখের সামনে পুড়তে দেখলাম। তিনি বলেন, চৌমুহনী থেকে পার্টি আইবো বলে রাতে আড়াই লাখ টাকার মাল এনে রাখছি। প্রায় ৪০ লাখ টাকার মাল ছিল দোকানে। এখন সবকিছুই ছাই।