ঢাকারবিবার , ১৯ মার্চ ২০২৩
  • অন্যান্য

রমজানের আগেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকাই বাজারে বেচাকেনা কম

অনলাইন ডেস্ক
মার্চ ১৯, ২০২৩ ১২:৪৭ অপরাহ্ণ । ১১৩ জন
ছবি: সংগৃহীত

চাঁদ দেখা সাপেক্ষে আগামী শুক্রবার শুরু হতে পারে পবিত্র রমজান মাস। আর এই মাস আসলেই বাড়ে অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। ইতিমধ্যেই রমজানের দরকারি পণ্য খেজুর, ছোলা, পিয়াজ, চিনি, ভোজ্য তেলসহ চাল, ডাল, আটা-ময়দা, মসলা, ডিম, মুরগি, মাছ ও মাংসের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ফলে সবকিছুর উচ্চমূল্যের কারণে বাজারে বেচাকেনা কম বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। তাদের মতে, রোজার আগে কেনাকাটার যে আমেজ ছিল, সেটা এখন আর নেই। কাস্টমার আগের চেয়ে কমে গেছে। গ্রাহকরা পরিমাণে কম কিনছেন। এ ছাড়া আগে যেভাবে মার্কেট জমে উঠতো, সেভাবে আর জমছে না। অস্বস্তিতে ক্রেতারা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, নিম্ন আয়ের মানুষেরা তাদের আয়ের অর্ধেকের বেশি খরচ করেন খাবারের জন্য।

সেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে থাকলে তাদের জীবনযাত্রা কষ্টকর হয়ে যায়। শুধু নিম্ন আয়ের নয়, এর চেয়ে বেশি আয়ের মানুষেরও এখন বাজার করতে কষ্ট হচ্ছে। অথচ বিশ্ব পরিস্থিতির অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা ভোক্তার পকেট কাটছে। সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি প্রশাসন। ছোলা, ডাল, চিনি, ভোজ্য তেলসহ প্রধান কয়েকটি পণ্যের সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় রমজান মাসে। এখনই উদ্যোগ নেয়া না হলে রোজার আগে পণ্যবাজার নতুন করে অস্থির হয়ে উঠতে পারে।
সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, দেশে চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি পণ্য মজুত রয়েছে। সরবরাহ স্বাভাবিক রয়েছে, রমজান মাসে কোনো পণ্যের ঘাটতি হবে না।
এদিকে দুই/তিন দিন আগে প্রধানমন্ত্রীও রমজানের আগে নিত্যপণ্যের সংকট নিয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, সামনে রমজান মাস। এ সময় আমাদের কিছু ব্যবসায়ী জিনিসের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করে। এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। কারণ রমজান মাস কৃচ্ছ্রসাধনের সময় এবং মানুষ যাতে ভালোভাবে তাদের ধর্মকর্ম এবং রোজা যথাযথভাবে পালন করতে পারে সেদিকেই সবার দৃষ্টি দেয়া উচিত। সে সময় এসব মুনাফালোভীর জিনিসের দাম বাড়ানো আর মানুষকে বিপদে ফেলার কোনো মানে হয় না।
রাজধানীর কাওরান বাজারে দেখা গেছে, দেশি ভালো জাতের ছোলা ১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১৫-১২০ টাকায়। ভালো মানের মসুর ডাল ১৫০ টাকা, খেসারি ডাল ৮০-৯০ টাকা, অ্যাংকরের বেসন ৭৫-৮৫ টাকা এবং বুটের বেসন বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকায়।
মুদি দোকানি বলছেন, জিনিসপত্রের দাম অত্যধিক বেশি হওয়ায় এবার রোজার আগেও অন্য বছরের তুলনায় মাল কম তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ মানুষ এখন উপায় না থাকায় কিনছে, এক কেজি লাগলে আধা কেজি কিনছে।
মুদি দোকানে কেনাকাটা করছিলেন বেসরকারি চাকুরে আসিফ। আলাপকালে তিনি জানান, রোজাকেন্দ্রিক রান্নার কাজে যেসব পণ্য বাসায় লাগে সেগুলো কিনতে বাজারে এসেছি। কিন্তু সব পণ্যেরই দাম বাড়তি। আগের মতো একসঙ্গে অনেক দিনের বাজার করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ছয় সদস্যের পরিবার। তার একার আয়েই সংসার চলে। প্রতিবছর রোজার আগে একসঙ্গে ৫-১০ দিনের বাজার করলেও এবার তা পারছেন না। সবই কিনছেন কাটছাঁট করে। যেমন; আগে একেবারে দুই কেজি ছোলা নিতেন। এবার কিনলেন আধা কেজি। তিনি বলেন, অল্প অল্প জিনিস কিনতেই ৮০০ টাকা শেষ। ৫৫-৬০ টাকার চিনি এখন ১২০ টাকা। এই টাকায় আগে ডাবল বাজার করা যেতো।

নাহিদ নামের একজন পোশাক শ্রমিক বলেন, আমার একজনের আয়ে স্ত্রী, দুই সন্তান ও বাবা-মাকে নিয়ে সংসার চলছে। রোজা আসছে ভেবেই চিন্তিত তিনি। কারণ সবকিছুর দামই প্রায় হাতের নাগালের বাইরে। অসুস্থ বাবা-মা ও সন্তানদের কথা ভেবে বাজার থেকে এক কেজি চাল ও কিছু সবজি কিনে বাসায় যান তিনি।
বাজারে বেশ কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে গেলেই দুশ্চিন্তায় পড়তে হয় তাদের। কারণ সব ধরনের দ্রব্যমূল্যের দর ঊর্ধ্বগতি। রোজা এলে ইফতারের আইটেম কেনা হয়। কিন্তু এবার দাম এত বেশি যে, একসঙ্গে দুই/এক দিনের বাজার করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষেরা আগের মতো বাজার করতে পারছেন না।
এদিকে বিক্রেতারা জানান, যারা আগে ৫ কিংবা ১০ কেজি করে চাল, ডাল কিংবা ছোলা কিনতেন, তারা এখন কিনছেন ১ বা ২ কেজি। কাস্টমার আগের চেয়ে কমে গেছে। পরিমাণে কম কিনছেন। মুদি দোকানি ফাইজুল বলেন, দোকানে বেচাকেনা খুবই কম। রোজার আগে যেভাবে এতদিন মার্কেট জমে উঠতো, সেভাবে এখন আর জমছে না। অনেক ক্রেতা দাম-দর জিজ্ঞেস করছেন কিন্তু দাম শুনে ফিরে যাচ্ছেন।

সাধারণত রোজার আগের শুক্রবারে মাছ-মাংসের দোকানে ভিড় জমতো। কিন্তু এবার দেখা গেল, সেই ভিড়ও কমেছে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে। বাজারে খাসির মাংসের দাম ১১০০ থেকে দোকানভেদে ৫০-১০০ টাকা বাড়তি, বেড়ে গেছে হাড় ছাড়া গরুর মাংসের দাম। হাড্ডি ছাড়া গরুর মাংস হাজার টাকা কেজি, হাড্ডিসহ ৭৫০ টাকা।
এদিকে বাজারে মুরগির দাম আরও বেড়েছে। আগের সপ্তাহের ২৫০ টাকার ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২৫৫-২৬০ টাকা কেজিতে। ৩৫০ টাকার সোনালি মুরগির দাম হয়ে গেছে ৩৬০ টাকা, আর ১০ টাকা বেড়ে লেয়ার মুরগির দাম হয়েছে ৩১০ টাকা। বাজারে কমেনি কোনো মাছের দাম। বরং দেশি নদ-নদীর মাছে কেজিতে ২০-৩০ টাকা দাম বেড়েছে।
বাজারে আসা মুহিব বলেন, মাছ মাংসের দাম একদম নাগালের বাইরে। আগে রোজা এলে চার/পাঁচটা মুরগি কিনতাম, এবার দুইটা নিলাম। মাছের দামও বেশি, মনমতো কিনতে পারি নাই। গরু-খাসির চিন্তা আগেই বাদ দিয়েছি।
রোজার আগে বেড়ে গেছে সবজির দামও। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি সবজিতে অন্তত ১০-২০ টাকা বেড়েছে। নতুন সবজির দাম বেড়েছে বেশি। ৬০ টাকার নিচে কোনো সবজি নাই। নতুন সবজি ১০০ টাকা কেজি। এক কেজি সজনার দাম ১৮০ টাকা, বরবটি, কচুরলতিও ১০০ টাকার উপরে।

বাজার নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, বাজার মনিটরিংয়ে আমাদের সাধারণত ৪০টি টিম সারা দেশে কাজ করে। রমজানে ৫০টি টিম কাজ করবে। আমরা মনিটরিং জোরদার করছি, তদারকি করছি। কেউ যদি দাম বাড়ায় কিংবা পণ্য মজুত করে বাজার অস্থিতিশীল করে, আমরা কঠোর অবস্থানে যাবো। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বৈঠকেও আমাদের এই বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বাজারে চাল, ডাল, চিনি ও সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যের দাম উচ্চমূল্যে এসে থেমে আছে। বাজারে প্রতি কেজি মোটা চাল খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকায়, যা গত বছর এ সময়ে ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকায়। মাঝারি মানের চালের দাম পড়ছে প্রতি কেজি ৬০ থেকে ৬২ টাকা। আর সরু চাল মিনিকেট ও নাজিরশাইল কিনতে হচ্ছে ৭০ থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে। এক কেজি প্যাকেটের পোলাওয়ের চাল ১৭০ টাকায় ঠেকেছে, যা ২০ দিন বা ১ মাস আগেও ছিল ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায়।
বর্তমানে বাজারে সাধারণ মানের প্রতি কেজি খেজুরের দাম ২০০ থেকে ৪৫০ টাকা, যা গত বছর সর্বোচ্চ বিক্রি হয়েছিল ১৫০ থেকে ৩৫০ টাকায়। আর যে খেজুর গত বছর ৩৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, বর্তমান বাজারে সেই খেজুরের কেজি ৬৫০ থেকে ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে আমদানিকারকরা জানিয়েছেন, দেশে বছরে ভোজ্য তেলের চাহিদার প্রায় ২২ লাখ টনের মধ্যে রমজানে সারা দেশে চাহিদা প্রায় ৩ লাখ টনের মতো। দেশে চিনির বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৪ লাখ টন, এর মধ্যে রমজানে চাহিদা থাকে প্রায় ২ লাখ ৭২ হাজার টনের মতো। একইভাবে বছরে ভোক্তাদের ছোলার চাহিদা ১ লাখ ৩৬ হাজার টন। এর মধ্যে রমজানেই ছোলার চাহিদা থাকে প্রায় ৯১ হাজার টনের মতো।