ঢাকামঙ্গলবার , ৩ অক্টোবর ২০২৩
  • অন্যান্য

এখন আইনেই সুযোগ খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার

অনলাইন ডেস্ক
অক্টোবর ৩, ২০২৩ ১:৫৬ অপরাহ্ণ । ৯৬ জন

প্রায় দুমাস ধরে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তার শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। স্থায়ী মুক্তি ও চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করে তার পরিবার। এ অবস্থায় তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হবে কিনা-তা নিয়ে কয়েকদিন ধরে বেশ সরগরম দেশের রাজনীতি।

প্রসঙ্গত, রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য দ্রুত বিদেশে নিয়ে চিকিৎসার পরামর্শ দিয়েছে মেডিকেল বোর্ড। এ অবস্থায় গত সোমবার উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার সুযোগ চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে তার পরিবার। মতামতের জন্য আবেদন পাঠানো হয় আইন মন্ত্রণালয়ে। রোববার আইন মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশে চিকিৎসার আবেদন নাকচ করে মত দেওয়া হয়।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আইনগতভাবে অনুমতি দেওয়ার কোনো সুযোগ সরকারের হাতে নেই। সেই মতামতই আইন মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়েছে। আইনে কেন সুযোগ নেই, সেই ব্যাখ্যা তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারায় কোনো দরখাস্ত যদি একবার নিষ্পত্তি করা হয়, সেই নিষ্পত্তি করা দরখাস্ত পুনর্বিবেচনা করার অবকাশ আইনে থাকে না। আমরা ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১-এর উপধারা ১, ২, ৩, ৪, ৫ এবং সর্বশেষ উপধারা ৬ ব্যাখ্যা করে মতামত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।

সেই মতামত হচ্ছে ৪০১ ধারার ক্ষমতাবলে যে দরখাস্ত নিষ্পত্তি করা হয়েছে, সেটির অতীতও শেষ হয়ে গেছে। এটি আর খোলার কোনো উপায় নেই।’ তিনি আরও বলেছেন, উপমহাদেশে ৪০১ ধারার ক্ষমতা যখন সরকার প্রয়োগ করে, তখন সেটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যায় না বলে সিদ্ধান্ত আছে। প্রধানমন্ত্রী যেটা বলেছেন, সেটি হচ্ছে এখন যে আদেশ আছে, সেটি যদি বাতিল করা হয়, বাতিল করে তাকে (খালেদা জিয়া) যদি আবার কারাগারে নেওয়া হয়, তাহলে আদালতে যেতে পারেন। বর্তমান অবস্থায় তিনি আদালতে যেতে পারেন বলে কোনো সুযোগ নেই।

উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেওয়ার বিষয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাছান চৌধুরী বলেন, ‘যেহেতু ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারার আলোকে আবেদনটিতে আগেই খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করা হয়েছিল। এ কারণে আর কোনো স্কোপ নেই অন্য কোনো আদেশ দেওয়ার। এখন তাকে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে যেতে হবে এবং জেলখানায় যাওয়ার পর তিনি জামিন আবেদন এবং বিদেশে চিকিৎসার জন্য আপিল বিভাগে আবেদন করতে পারেন। কারণ সাজার বিরুদ্ধে তার আপিল পেন্ডিং রয়েছে। এছাড়া খালেদা জিয়া তার দোষ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতির কাছেও আবেদন করতে পারেন।’

আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, ‘খালেদা জিয়া এখন যে অবস্থায় আছেন সেই অবস্থায় রেখেই তাকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে অনুমতি দেওয়া যায়। আইনে সে সুযোগ আছে। খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে ছয় মাসের জন্য নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া হয়। এর পর ছয় মাস তা বাড়ানো হয়েছে। বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আইনমন্ত্রী যে বলছেন ওই আবেদন নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, আইনে আর কিছু করার নেই। তাহলে আমার প্রশ্ন তার মুক্তির মেয়াদ আরও আটবার বাড়ানো হলো কোনো আইনে? যদি ওটা ক্লোজ হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে তো তার মুক্তির মেয়াদ ছয় মাসেই শেষ হওয়ার কথা ছিল।’

আইনমন্ত্রী ৪০১ ধারার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন এই আইন বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে ৪০১ ধারায় বলা আছে, সরকার শর্ত সাপেক্ষে বা শর্তহীনভাবে কারও দণ্ড মওকুফ বা স্থগিত করতে পারে। খালেদা জিয়ার দণ্ড শর্ত সাপেক্ষে স্থগিত করে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। শর্ত হলো তিনি ঢাকায় চিকিৎসা করাবেন এবং দেশের বাইরে যেতে পারবেন না।

এখন তাকে শর্তহীনভাবে মুক্তি দেওয়া যায়। অথবা বলে দেওয়া যায় তিনি যেখানে প্রয়োজন চিকিৎসা করাতে পারবেন। এর জন্য তাকে তো আবার কারাগারে গিয়ে আগের আদেশ বাতিল করে আবেদন করার দরকার নেই। তাই যদি করতে হয় তাহলে সরকার কীভাবে তার সাজা স্থগিতের মেয়াদ এতবার বাড়াল? আর হ্যাঁ সেখানেও একটা শর্ত দেওয়া যেতে পারে যে, তিনি বিদেশে চিকিৎসা শেষে এক মাসের মধ্যে দেশে ফিরে আসবেন।’

শাহদীন মালিক অবশ্য বলেন, এটি করার ক্ষেত্রে সরকারের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। নির্বাহী সিদ্ধান্ত হওয়ায় তা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাধীন। ম্যান্ডেটরি নয়। তা না হলে সব আসামি বলবে আমাকে ছেড়ে দাও। কিন্তু খালেদা জিয়া বৃদ্ধ বয়সে অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত। তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে না যেতে দিয়ে সরকার তার জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে বলে অভিমত এই আইনজীবীর।

সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, চিকিৎসা সুবিধার জন্য বিদেশে যেতে পারেন। বেঁচেই যদি না থাকেন তাহলে বিচার করবে কার। নির্বাহী আদেশে সরকার চাইলে অনুমতি দিতে পারে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মহানুভবতায় বিএনপি চেয়ারপারসনকে বাসায় থাকতে দেওয়া হয়েছে। সেজন্য সবাই প্রত্যাশা করছে যেহেতু উনি খুবই অসুস্থ, তাই তাকে সঠিক চিকিৎসার সুযোগটা দেওয়া উচিত। সেটা যেভাবেই করুক। তা নির্ভর করছে সরকারের ইচ্ছার ওপর। যেহেতু তিনি দুবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং একটা বড় রাজনৈতিক দলের প্রধান, সে কারণে উনাকে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া উচিত।

খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, খালেদা জিয়ার পরিবার চাইলে সরকারের এ সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনা চাইতে পারে। খালেদা জিয়া এখন নির্বাহী আদেশের যে অবস্থায় আছেন, তাতে করে আদালতে যাওয়ারও সুযোগ নেই। আমরা সরকারকে বলেছি, আপনারা আরও মানবিক হন। মানবিক হয়ে খালেদা জিয়ার জীবনকে বাঁচান।

খালেদা জিয়ার আরেক আইনজীবী এবং বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, ‘খালেদা জিয়াকে যে ৪০১ ধারায় শর্ত সাপেক্ষে মুক্তি দেওয়া হয়েছে, সেই ধারায়ই শর্তহীনভাবে মুক্তি দেওয়ার বিধান আছে। তিনি বলেন, ‘আইনমন্ত্রী আইনের অপব্যাখ্যা দিচ্ছেন। খালেদা জিয়াকে শর্তমুক্তভাবে মুক্তি দিলেই তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে পারেন।

তিনি বলেন, ‘কারাবন্দি অবস্থায় বিদেশে চিকিৎসার অনেক উদাহরণ আছে। জেএসডি সভাপতি আসম আব্দুর রবও কারাবন্দি অবস্থায় বিদেশে চিকিৎসা করেছেন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ওয়ান-ইলেভেনের সময় নির্বাহী আদেশে বিদেশে চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন।’ কায়সার কামাল দাবি করেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসকরা বলেছেন, বাংলাদেশে তার আর চিকিৎসা সুবিধাপ্রাপ্তির সুযোগ নেই। এ অবস্থায় তাকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে না দেওয়ার মানে হলো, তার (খালেদা জিয়া) জীবননাশের একটি পদক্ষেপ। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এটা করা হচ্ছে।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠানো হয়। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর দণ্ড স্থগিত করে দুটি শর্তে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তখন করোনা মহামারির মধ্যে তার পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে ৬ মাসের জন্য মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর থেকে পরিবারের আবেদনে ৬ মাস অন্তর তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। যে দুটি শর্তে নির্বাহী আদেশে সরকার খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিয়েছে, তার প্রথমটি হলো তাকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিতে হবে।

দ্বিতীয় শর্তটি হলো, তিনি বিদেশ যেতে পারবেন না। ৯ আগস্ট অসুস্থ হয়ে পড়লে খালেদা জিয়াকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, খালেদা জিয়ার লিভারের জটিলতা বৃদ্ধি এবং কিডনি সমস্যার কারণে শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়েছে।

এর আগেও ১৩ জুন রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ওই সময় ৫ দিন পর তিনি বাসায় ফেরেন। গত বছরের জুনে খালেদা জিয়ার এনজিওগ্রাম করা হলে তার হৃদযন্ত্রে তিনটি ব্লক ধরা পড়ে। এর একটিতে রিং পরানো হয়। ৭৮ বছর বয়সি খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার ও হৃদরোগে ভুগছেন।

messenger sharing button