ঢাকামঙ্গলবার , ৯ এপ্রিল ২০২৪
  • অন্যান্য

ইসরায়েলের সঙ্গে ইরান কি এবার সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করবে

অনলাইন ডেস্ক
এপ্রিল ৯, ২০২৪ ১১:৫৮ পূর্বাহ্ণ । ১০ জন

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে ভয়াবহ হামলায় তিনজন ইরানি কমান্ডারসহ এক ডজনের বেশি নিহত হয়েছেন। এ হামলায় তেহরান তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার ঘোষণা দেয় এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি সভা ডাকার আহ্বান জানান।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ান ওয়াশিংটনে তাঁর সরকারের কড়া বার্তা পৌঁছে দেন। সেই বার্তায় তেহরান জানায়, ‘জায়নবাদী সরকারের’ সমর্থক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকেও অবশ্যই এর দায় নিতে হবে।

এটা পরিষ্কার যে ইরান প্রতিশোধ নিতে চায়। ইরানের শীর্ষ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেছেন, ‘এই বদমাইশদের আমাদের সাহসী সন্তানেরা অবশ্যই শায়েস্তা করবে। এই অপরাধের জন্য আমরা অবশ্যই পরিতাপ করিয়ে ছাড়ব।’

প্রেসিডেন্ট রাইসি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এই অন্যায্য অপরাধের জবাব না দিয়ে থাকা হবে না। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ ভাহিদি এক্সে বলেন, ‘আমরা কী প্রতিক্রিয়া দেখাব, সেটা দেখার অপেক্ষা করুক জায়নবাদীরা।’

ইরানের রাজনৈতিক মহলে সম্মিলিতভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এদের অনেকে অন্য দেশে ইসরায়েল দূতাবাসে প্রতিশোধমূলক হামলা করার দাবি জানিয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে দামেস্কের ইরানি কনস্যুলেট ভবনে ইসরায়েলের হামলা ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাত, নতুন স্তরে উত্তরণের স্মারকচিহ্ন হয়ে থাকবে। ধাপে ধাপে এই সংঘাত ছায়া যুদ্ধ অতিক্রম করে আরও অনেক দূরে পৌঁছে যাবে।

সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ আরম্ভ এবং দেশটিতে ইরানি সেনাদের উপস্থিতি শুরুর পর থেকে ইসরায়েল সেখানে অনেকগুলো হামলা চালিয়েছে। কিন্তু এসব হামলা প্রাথমিকভাবে ইরানি প্রক্সিদের অস্ত্র সরবরাহ করা হয় এমন স্থাপনা ও যানবাহন লক্ষ্য করে চালানো হলেও পরে ধাপে ধাপে জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে।

দামেস্কে সর্বশেষ এই হামলা পরিষ্কারভাবে পূর্বপরিকল্পিত। ইরানের শীর্ষ কমান্ডারদের হত্যার উদ্দেশ্যেই এই হামলা। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বোচ্চ পদাধিকারী ছিলেন জেনারেল রেজা জাহেদি। ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডসের এই জ্যোষ্ঠ কমান্ডার লেবানন ও সিরিয়ায় ইরানের সামরিক কর্মকাণ্ডের সমন্বয়ক ছিলেন।

৭ অক্টোবর গাজায় হামলা শুরুর পর থেকে ইরানি সেনাদের ওপর হামলা ও হত্যা বাড়িয়েছে ইসরায়েল। এ সময়ে সিরিয়ায় সন্দেহজনক ইসরায়েলি হামলায় রেভল্যুশনারি গার্ডসের অন্তত ১৭ সদস্য নিহত হয়েছেন। জানুয়ারি মাসে রেভল্যুশনারি গার্ডসের পাঁচ সদস্যকে হত্যার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে ইরান। এর মধ্যে সাজেদ ওমিদজাদেহ ছিলেন, যিনি কুদস ফোর্সের গোয়েন্দা কর্তা হিসেবে কাজ করতেন। এক মাস আগে, জেনারেল সাইয়েদ রাজি মৌসাভি দামেস্কের বাইরে বিমান হামলায় নিহত হয়েছিলেন। জেনারেল মৌসাভি সিরিয়া ও ইরানের মধ্যে সামরিক যে জোট তার সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করতেন।

কিন্তু ইরানের কনস্যুলেট ভবনে হামলা আগ্রাসনের চূড়ান্ত পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। এই হামলায় ইরান উদাসীন বসে থাকতে পারবে না। কেননা, কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার তাদের যে বাগাড়ম্বর, তাতে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু এর পরও বেশ কিছু বিষয় আছে। তেহরানকে অবশ্যই সেই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে।

প্রথমত, ইসরায়েলের সঙ্গে ইরান পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধে জড়াতে চায় না। তাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধের ঝুঁকি তৈরি হবে। দ্বিতীয়ত, এই ধরনের সংঘাতে খেলা চলে যাবে ইসরায়েলের হাতে। যেহেতু তেহরানের সঙ্গে সংঘাত লাগিয়ে তেল আবিব গাজা যুদ্ধকে বৈশ্বিক রূপ দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। ইসরায়েল চায় ইরানের সঙ্গে সংঘাত বাধিয়ে গাজায় তারা যে গণহত্যা চালিয়েছে, তা থেকে বিশ্বের দৃষ্টি সরিয়ে দিতে।

তৃতীয়ত, ইরান তীব্র সংকটের  মধ্যে রয়েছে। যুদ্ধ চালাতে গেলে শক্তিশালী অর্থনীতি দরকার। কিন্তু ইরানে এখন মূল্যস্ফীতি ৪০ শতাংশ, তাদের মুদ্রার বিনিময় হার এখন দুর্বল, বাজেটঘাটতিও অনেক। একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া সহজ। কিন্তু যুদ্ধ থেকে বের হতে গেলে কয়েক মাস থেকে কয়েক বছরও লেগে যেতে পারে। তাতে করে দেশ ও নাগরিকদের ওপর বিশাল অর্থনৈতিক চাপ পড়ে।

পরিশেষে ইরানের জনগণ যুদ্ধ শুরু হোক তাতে সমর্থন দিচ্ছে না। ২০২২ সালে ‘নারী, জীবন, মুক্তি’ আন্দোলনে ইরান সরকার ব্যাপকভাবে জনসমর্থন হারিয়েছে। অনেকটাই বৈধতার সংকটেও পড়তে হয়েছে।

সর্বাত্মক যুদ্ধের পরিবর্তে ইরান প্রক্সি সংঘাতের মধ্য দিয়ে অপ্রত্যক্ষভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বড় ধরনের আক্রমণের বদলে তেহরান  ‘একগুচ্ছ ছোট হামলার’ মধ্য দিয়ে তেহরান বদলা নিতে পারে বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক থিংক ট্যাংক চ্যাটাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচির পরিচালক সানাম ভাকিল।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেট ভবনে হামলার নিন্দা জানানো হয়। চীন ও রাশিয়া বলেছে, এটা আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন। ইরান যখন তাদের সম্ভাব্য পদক্ষেপের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ঐকমত্য তৈরি করতে চাইছে, তখন কনস্যুলেট ভবনে হামলার ঘটনায় আরব বিশ্বের দেশগুলো ইসরায়েলকে নিন্দা জানিয়েছে।

আসন্ন সপ্তাহ ও মাসগুলাতে যুক্তরাষ্ট্র ও বিদেশি বাহিনীগুলোর স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্থানগুলোতে হামলার সম্ভাবনা রয়েছে। এ বছরের শুরুর দিকে জর্ডান-সিরিয়া সীমান্তে ইরান–সমর্থিত প্রক্সি গোষ্ঠীর হামলায় কয়েকজন আমেরিকান সেনা নিহত হন। গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়ার কারণে মার্কিন সেনাদের ওপর এই হামলা হয়। এর পাল্টায় যুক্তরাষ্ট্রও বেশ কয়েক দফা হামলা চালায়। এরপর পরিস্থিতি আবার শান্ত হয়ে যায়। এবারের দামেস্কে কনস্যুলেটে হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পৃক্ততা নেই, তা জানিয়ে দিয়েছে ওয়াশিংটন।

মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ইরানি প্রক্সিরা এখন হামলা বাড়াতে পারে। যেমন লোহিত সাগরে হুতিরা হামলা বাড়াতে পারে। কিন্তু প্রক্সিদের হামলা নিশ্চিতভাবেই এখন ভিন্ন হবে। এবার তারা ইসরায়েলের দূতাবাসসহ আরও সংবদেনশীল এলাকায় হামলা করতে পারে।

দামেস্কে ইরানি কনস্যুলেটে হামলা তেহরান ও তেল আবিবের মধ্যকার ছায়াযুদ্ধের গতিপ্রকৃতি পাল্টে দেবে। ইরান অনেকগুলো কারণেই ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়াবে না। কিন্তু ভিন্ন পথে তারা প্রতিশোধ নেবে।

  • মোহাম্মদ সালামি, ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর গ্লোবাল স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালিসিসের গবেষণা সহকারী
    মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে