উন্নয়ন প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয়ের লাগাম টানা যাচ্ছে না। বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণ বা অনুদান আছে এমন প্রকল্পে পরামর্শক নেওয়াটাই যেন নিয়তি। এরকম সাত প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১৫৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্টরা স্বীকারও করছেন উন্নয়ন সহযোগীদের চাপে বাধ্য হয়েই অনেক ক্ষেত্রে নিতে হচ্ছে পরামর্শক।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে, দেশের যেসব কর্মকর্তা দক্ষ হচ্ছেন তাদের কাজে লাগানো যাচ্ছে না কেন। এমনকি সাধারণ কাজেও অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পুরোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান পরামর্শক নির্ভর থাকছে কেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন তুলেছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একনেক বৈঠকে তিনি বলেছেন, প্রকল্পে এত পরামর্শক লাগবে কেন। আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা দক্ষতা অর্জন করেছেন। তাহলে তারাই কেন এসব কাজ করতে পারছেন না।
বিশ্লেষকদের কয়েকজন বলেন, সরকারের উচিত হবে দ্রুত পরামর্শক পলিসি প্রণয়ন করা। সেখানে সুস্পষ্ট করে দিতে হবে কোন কাজে কোন ধরনের পরামর্শক নেওয়া হবে। একইসঙ্গে দেশীয় দক্ষ পরামর্শকদের নিয়ে পরামর্শক পুল গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনে সরকারি অর্থ ব্যয়ে তাদের বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে আনতে হবে। তা না হলে নীতিনির্ধারক মহলের এসব বক্তব্য কোনো কাজে আসবে না।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নানবলেন, অনেক সময় ইচ্ছে না থাকলেও আমাদের পরামর্শক নিতে হয়। বিশেষ করে বৈদেশিক ঋণের প্রকল্পে এটা হয়ে থাকে। ইদানীং উন্নয়ন প্রকল্পে পরামর্শক নিয়ে নানা সময় কথা বলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীও সম্প্রতি একনেকে নির্দেশনা দিয়েছেন। বলেছেন-উন্নয়ন প্রকল্পে অহেতুক পরামর্শক যেন নেওয়া না হয়, দেশীয় পরামর্শকদের কাজে লাগাতে হবে। নির্দেশনা বাস্তবায়নে আমরা কাজ করছি। কিন্তু বৈদেশিক ঋণ আছে এমন প্রকল্পের ক্ষেত্রে কিছুটা বাধ্য হয়েই পরামর্শক নিতে হয়। কেননা তাদের একটা চাহিদা থাকে বিদেশি পরামর্শক দিয়ে কাজটা করানো। তারা মনে করে তাদের দেওয়া পরামর্শকরা অনেক বেশি দক্ষ হয়ে থাকে। এতে কাজের মান ঠিক থাকবে। সেক্ষেত্রে এক অর্থে আমাদের দিক থেকেও কিছু করার থাকে না।
সূত্রমতে যেসব প্রকল্পে বিপুল অর্থ ব্যয়ে পরামর্শক নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে সেগুলো হলো-উপকূলীয় শহর জলবায়ু সহিষ্ণু প্রকল্প এবং ‘চট্টগ্রাম-দোহাজারী মিটার গেজ রেলপথকে ডুয়েলগেজ রেলপথে রূপান্তর প্রকল্প। এছাড়া ‘কোভিড-১৯ ইমারজেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপার্ডনেস। টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ফর রিজিওনাল কানেক্টিভিটি প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি অ্যান্ড পলিসি ডেভেলপমেন্ট ফর এমভিএ অ্যান্ড টিআইআর কনভেনশন প্রকল্প। আরও আছে ‘সাসেক ঢাকা-সিলেট করিডোর সড়ক উন্নয়ন, প্রমোটিং জেন্ডার রেসপন্সিভ এন্টারপ্রাইজ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড টিভিইটি সিস্টেম প্রকল্প। খাদ্য নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য দেশে আটটি আধুনিক খাদ্যগুদাম বা সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্প। এসব প্রকল্পে বিদেশি অর্থায়ন বেশি। যে কারণে তাদের প্রস্তাবিত পরামর্শক রাখার ব্যপারে চাপও বেশি।
পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষতার ঘাটতি আছে। যে কারণে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি পরামর্শক নিতে হয়। কিন্তু রাস্তাঘাট তৈরি বিশেষ করে এলজিইডির প্রকল্পে বিদেশি পরামর্শক লাগার কথা নয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত পরামর্শক নিয়ে অর্থের অপচয় কখনও কাম্য হতে পারে না।
সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ রোববার বলেন, সাধারণত বিদেশি ঋণ বা অনুদান আছে এমন প্রকল্পে অধিক পরামর্শক রাখার প্রবণতা দেখা যায়। প্রয়োজন নেই এমন পরামর্শকও ধরা হয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের উচিত পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেই এ খাতে ব্যয় নির্ধারণ করা। এক্ষেত্রে পরামর্শকদের টার্ম অব রেফারেন্স (টিওআর) ভালোভাবে যাচাই করা দরকার।
সূত্র জানায়, গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব দেওয়া হয় ‘উপকূলীয় শহর জলবায়ু সহিষ্ণু’ প্রকল্প। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয় দুই হাজার ৬৬৬ কোটি টাকা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। এ প্রকল্পে পরামর্শক খাতে প্রস্তাব করা হয়েছে ১৪৩ কোটি টাকা। কিন্তু এ ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠে পিইসি সভায়। ওই সভার সভাপতি এবং পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সাবেক সদস্য বর্তমান পরিকল্পনা সচিব সত্যজিত কর্মকার নিজেই প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, সদ্যসমাপ্ত প্রকল্পের আওতায় প্রস্তাবিত প্রকল্পের ৩০ শতাংশ রেডিনেস (প্রস্তুতি) সম্পন্ন করা হয়েছে। অবশিষ্ট ৭০ শতাংশ কার্যক্রমও প্রায় একই প্রকৃতির। এরপরও এই প্রকল্পে ১৪৩ কোটি টাকার পরামর্শক ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছে। তাই একই প্রকৃতির বিষয়ভিত্তিক পরামর্শকের সংখ্যা ও জনমাস (কতজন, কত মাস কাজ করবে) কমিয়ে এ খাতের ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে কমাতে হবে।
এছাড়া মার্চে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব আসে ‘চট্টগ্রাম-দোহাজারী মিটার গেজ রেলপথকে ডুয়েলগেজ রেলপথে রূপান্তর’ শীর্ষক প্রকল্পের। এটির মোট ব্যয় ছিল সাত হাজার ৭৩ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ রয়েছে এটিতে। এতে পরামর্শক ব্যয় প্রস্তাব করা হয় ২৫৪ কোটি ৭৫ লাখ ৯৩ হাজার টাকা। পিইসি সভাতে এ ব্যয়ের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠে।
সম্প্রতি দ্বিতীয় সংশোধনীর প্রস্তাব আসে ‘কোভিড-১৯ ইমারজেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যানডেমিক প্রিপার্ডনেস’ প্রকল্পের। এটির দ্বিতীয় সংশোধন প্রস্তাবে ব্যয় বাড়িয়ে প্রাক্কলন করা হয় সাত হাজার ৯৬ কোটি ৫৮ লাখ ৮১ হাজার টাকা। মূল প্রকল্পে নয়জন পরামর্শকের বিপরীতে চার কোটি টাকার সংস্থান ছিল। সংশোধন প্রস্তাবেও নয়জনের বিপরীতে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ১৫ কোটি ৫৬ লাখ ৫২ হাজার টাকা। এ ব্যয়কে অযৌক্তিক বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন।
এদিকে মার্চে পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব আসে ‘টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট ফর রিজিওনাল কানেক্টিভিটি প্রিপারেটরি ফ্যাসিলিটি অ্যান্ড পলিসি ডেভেলপমেন্ট ফর এমভিএ অ্যান্ড টিআইআর কনভেনশন’ প্রকল্পের। ১২৭ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটিতে পাঁচ ধরনের পরামর্শকের পেছনেই ১১৬ কোটি ৩৮ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক।
সম্প্রতি পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব আসে আটটি আধুনিক খাদ্য গুদাম ও সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্প সংশোধনীর। এর মাধ্যমে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে খরচ দ্বিগুণের বেশি হয়ে চার হাজার ৪৫ কোটি টাকায় উন্নীত করার কথা বলা হয়। এখানে আটটি সাইলো বানাতে তিন ধরনের পরামর্শকের পেছনে ব্যয় ধরা হয় পৌনে ৩০০ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়নে ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক।
সম্প্রতি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে ‘প্রমোটিং জেন্ডার রেসপনসিভ এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড টিভিইটি সিস্টেম’ প্রকল্পের। এটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১২৮ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে চার ধরনের পরামর্শকের জন্য খরচ ধরা হয়েছে ৩১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এছাড়া ২০২০ সালের শেষ দিকে প্রস্তাব করা হয় ‘সাসেক ঢাকা-সিলেট করিডোর সড়ক উন্নয়ন’ প্রকল্পের। এটির মোট ব্যয় ধরা হয় ১৭ হাজার ১৬১ কোটি ৯২ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে তিন হাজার ৫৫০ কোটি ২৮ লাখ টাকা এবং এডিবির ঋণ থেকে দেখানো হয় ১৩ হাজার ৬১১ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয় প্রস্তাব করা হয় ৩২৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। পিইসির সভায় এই পরামর্শক ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।