সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার পঞ্চাশোর্ধ্ব জিতু মিয়া তালুকদার। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে তার সংসার। বড় ছেলে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে থাকেন। বাড়ির কৃষিকাজ ও বড় ছেলের প্রবাসের আয়েই চলে সংসার। কয়েক বছর ধরে জিতু মিয়া স্বপ্ন দেখছেন হজে যাবেন। বড় ছেলের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনাও করেছেন। খরচের হিসাবও মিলিয়েছিলেন। কিন্তু মহামারি করোনার পরের বছর হজযাত্রার বাড়তি খরচ ও বিধিনিষেধ থাকায় তার আর যাওয়া হয়নি। সে বছর হজের প্যাকেজ ছিল ৫ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা। ভেবেছিলেন এবছর হয়তো খরচ অনেকটা কমে যাবে।
সে অনুযায়ী তিনি টাকার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এবছর সরকার নির্ধারিত হজের প্যাকেজ মূল্য ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা। যা গত বছরের তুলনায় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৭৫ টাকা বেশি। বাড়তি খরচের কারণে এবছরও তিনি হজে যেতে পারছেন না।
শুধু জিতু মিয়া তালুকদারই নন, বছর বছর হজের প্যাকেজ মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে সাধ্যের বাইরে চলে যাওয়াতে অনেকের পক্ষেই এখন হজযাত্রায় শামিল হওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে হজের প্যাকেজের মূল্য বেড়েছে ৩ লাখ ৩৮ হাজার ১৫ টাকা। ২০১৯ সালে যেখানে প্যাকেজ মূল্য ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার আর ৫ বছরের মাথায় চলতি বছর ২০২৩ সালে সেটি হয়েছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা। এর আগে ২০১৫ সালে হজের সর্বনিম্ন খরচ ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০৬ টাকা। ২০১৬ সালে সেটি বেড়ে হয় ৩ লাখ ৪ হাজার টাকা। ২০১৭ সালে সর্বনিম্ন প্যাকেজ ছিল ৩ লাখ ১৯ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা। সূত্রমতে, হজের প্যাকেজ মূল্য প্রতি বছর যেসব কারণে বাড়ছে তার অন্যতম কারণ বিমান ভাড়া। প্রতি বছরই বিমান ভাড়া বৃদ্ধির কারণে হজ প্যাকেজের মূল্য বাড়ছে। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে হজযাত্রীদের নির্ধারিত বিমান ভাড়া ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২৩ সালে নির্ধারিত বিমান ভাড়া পূর্বের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। ২০১৭ সালে হজ যাত্রীদের বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ১৮ হাজার ৭৩৭ টাকা। ২০১৮ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ২৮ হাজার ৬৫০ টাকা। ২০১৯ সালে ৬৫০ টাকা কমে হয় ১ লাখ ২৮ হাজার। ২০২২ সালে ১ লাখ ৪০ হাজার ও চলতি বছরে করা হয়েছে ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা।
২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিমান ভাড়াই বেড়েছে ৭৯ হাজার ২৬৩ টাকা। আর গত বছরের তুলনায় চলতি বছর বেড়েছে ৫৮ হাজার টাকা। হজ এজেন্সি মালিক ও ট্র্যাভেল এজেন্টরা জানিয়েছেন, প্রতি বছর যাত্রীদের খরচের বড় একটি অংশ যায় বিমানের টিকিটে। বিমান ভাড়া বাড়লেই হজ প্যাকেজের খরচ বাড়ে। হজ যাত্রীদের ভাড়া নির্ধারণ করা হয় রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রস্তাবিত ভাড়ার ভিত্তিতে। তারা মনে করছেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স অতিরিক্ত মুনাফা ধরে প্রতি বছর হজযাত্রীদের ভাড়া প্রস্তাব করে। প্রতিবছর বিমান শুধুমাত্র হজ ফ্লাইট থেকে বড় অঙ্কের মুনাফা করে। যা বিমানের আয়ের প্রায় ১৫ শতাংশ। অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা চাইলে অল্প মুনাফা ধরে ভাড়া প্রস্তাব করতে পারে। এতে করে হজযাত্রীদের প্যাকেজের মূল্য অনেকটা কমে যায়। তারা কিছুটা হলেও আর্থিকভাবে স্বস্তি পান। তাই বিমান ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে স্বতন্ত্র টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে হজ এজেন্সি মালিকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যেখানে সৌদি আরবসহ অনেক দেশ হজের খরচ কমাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশে খরচ বাড়ছে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া, বিমান ভাড়া বৃদ্ধি, সৌদি আরবে হজযাত্রীদের বাসা ভাড়া বাবদ ও আনুষঙ্গিক খরচ বাড়তি ধরায় হজের প্যাকেজ মূল্য বেড়েছে।
প্রতি বছরই বিমানের ভাড়া নিয়ে সরব হজ এজেন্সি ও ট্র্যাভেল এজেন্টরা। বিগত বছরেও ভাড়া নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছিল হাব। এ বছর ১৪ই ফেব্রুয়ারি আটাব বিমান ভাড়াসহ প্যাকেজ মূল্য পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত আবেদন করেছে। এসোসিয়েশন অব ট্র্যাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) মহাসচিব আবদুস সালাম আরেফ বলেন, আমরা যারা হজযাত্রীদের নিয়ে কাজ করি তারা গত বছর করোনার পরবর্তী বছর হওয়াতে ব্যবসা করতে পারেনি। এর আগের দুই বছরও করোনার কারণে বন্ধ ছিল হজযাত্রা। এ বছর যারা ভেবেছিলেন হজ করবেন তারা বাড়তি খরচের কারণে পারছেন না। কারণ গত বছরের তুলনায় চলতি বছর খরচ দেড় লাখ টাকা বেড়েছে। নতুনরাও যেমন আগ্রহ দেখাচ্ছেন না ঠিক তেমনি যারা প্রাক নিবন্ধন করেছিলেন তাদের অবস্থাও একই। অথচ প্রাক নিবন্ধনকারীদের সঙ্গে আমরা গত কয়েক বছর ধরে যোগাযোগ রাখছি। তাদের আশ্বাস দিয়েছিলাম এ বছর খরচ কমবে। তিনি বলেন, প্রতি বছরই কঠিন হয়ে যাচ্ছে হজযাত্রা। যাদের অঢেল টাকা আছে তাদের পক্ষেই সম্ভব। সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। হজ এজেন্সিস অব বাংলাদেশ (হাব) সচিব মো. মাহবুব-উল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, হজ প্যাকেজের মূল্য নিয়ে হাব কর্তৃপক্ষও সন্তুষ্ট নয়। এজেন্সি মালিকরা খরচ কমানোর জন্য এসোসিয়েশনের সভাপতির কাছে চিঠি নিয়ে আসছেন। সভাপতিও চেষ্টা করছেন কীভাবে খরচ সাধ্যের মধ্যে আনা যায়। কারণ যে মূল্য ধরা হয়েছে সেটি গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষের সাধ্যের বাইরে।