সদ্য সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদকে রাষ্ট্রীয় নানা আয়োজন ও রীতির মাধ্যমে বঙ্গবভন থেকে বিদায় জানানো হয়েছে। বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় দায়িত্ব পালন করে এমনিতেই তিনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তাঁর আনুষ্ঠানিক বিদায়, আচার-অনুষ্ঠানও ছিল তাই অনেকটা বিরল।
স্বাধীন বাংলাদেশ ১৬ জন রাষ্ট্রপতি দেখেছে। এর মধ্যে দুজন রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় তাঁদের হত্যার ঘটনা ঘটেছে। কেউ কেউ দায়িত্ব পালন করেন স্বল্প সময়ের জন্য, ছিলেন অস্থায়ীও। অনেকে একাধিকবার রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হয়েছেন। মেয়াদ শেষের আগেই পদ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন কেউ কেউ।
আবদুল হামিদ গতকাল সোমবার নতুন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। প্রবীণ রাজনীতিক আবদুল হামিদ প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান তখন সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর ২০১৩ সালের ২০ মার্চ তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হন। পরে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি ২০১৩ সালের এপ্রিলে দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান। দুই মেয়াদেই তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। সব মিলিয়ে ১০ বছর ৪১ দিন রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের ৫২ বছরের ইতিহাসে এর আগে বঙ্গভবন থেকে এমন নানা আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির বিদায় দেখা যায়নি।
হত্যা, ক্যু ও পাল্টা ক্যু
বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অবশ্য তাঁর অবর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে ১৯৭২ সালের ১০ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। এক মাস পরই ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তিনি ১৯৭৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান তৎকালীন স্পিকার মোহাম্মদউল্লাহ। ১৯৭৪ সালের ২৭ জানুয়ারি তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশাল প্রতিষ্ঠা করলে পরদিন থেকে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই বছরের ১৫ আগস্ট একদল সেনাসদস্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার নির্মমভাবে হত্যা করেন।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সেই ঘটনার অন্যতম পরিকল্পনাকারী খোন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হন। তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট সহচরদের গ্রেপ্তার করেন। অবশ্য এর মধ্যে ক্যু, পাল্টা ক্যু চলতে থাকে। তিন মাসের মধ্যে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন মোশতাক। তিনি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এর মধ্যে সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান মুক্ত হন। উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে তখন প্রকৃত ক্ষমতা চলে যায় জিয়াউর রহমানের হাতে। ১৯৭৬ সালের ২৯ নভেম্বর জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হন। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম পদত্যাগ করলে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হন। ক্যু, পাল্টা ক্যু, হ্যাঁ-না ভোটের পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন দেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৮ সালের জুনে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন জিয়া। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে একদল সেনাসদস্যের হাতে নিহত হন জিয়া। এরপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তার। পরে তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
এর মধ্যে দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন তৎকালীন সেনাপ্রধান এইচ এম এরশাদ। ১৯৮২ সালে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এরশাদ। টানা ৯ বছর আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর বিচারপতি মো. সাহাবুদ্দীনের অস্থায়ী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হন এরশাদ।
এরশাদের পতনের পর সংসদীয় পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি
১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা পুনরায় চালু হয়। এরপর রাষ্ট্রপতির পদ অনেকটা অলংকারিক হয়ে পড়ে। রাষ্ট্রপতি হন বিএনপির আবদুর রহমান বিশ্বাস। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তৎকালীন সেনাপ্রধান আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমের ক্যু ব্যর্থ হয়ে যায়। আবদুর রহমান বিশ্বাস তাঁর স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ করেন। তিনি বিদায় সংবর্ধনা পাননি। তাঁর বিদায়ের সময়, ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছিল।
১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসে, তখন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুরোধে সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। পরে অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সাহাবুদ্দীন আহমদের সম্পর্কে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাহাবুদ্দীন আহমদের পাঁচ বছরের মেয়াদ ২০০১ সালের নভেম্বরে যখন শেষ হয়, তখন বিএনপি আবার ক্ষমতায় এসেছিল। সাহাবুদ্দীন আহমদও বঙ্গভবন থেকে বিদায় নেওয়ার সময় বিদায় সংবর্ধনা পাননি।
তবে এরশাদ সরকারের পতনের পর আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেছিলেন এবং সেই সরকারের অধীন সব দলের অংশ গ্রহণে নির্বাচন হয়েছিল।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছিল দলটির তৎকালীন নেতা এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে। তবে মাত্র সাত মাস সাত দিন পরই তাঁকে রাষ্ট্রপতির পদ ছাড়তে হয়। এর মধ্যে দল থেকে তাঁকে পদত্যাগের অনুরোধ জানানো হয়। তা না হলে ইমপিচ বা অভিশংসন করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হয়।
মোটাদাগে, রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে না যাওয়া এবং জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উল্লেখ না করা। তখন দলের চাপের মুখে বদরুদ্দোজা চৌধুরী পদত্যাগ করেন এবং তৎকালীন স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। বিএনপি সরকার ২০০২ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর খালেদা জিয়ার সরকারের মেয়াদ শেষ হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান কে হবেন, এই নিয়ে বিরোধী দলের সঙ্গে সংকট তৈরি হয়। এর মধ্যে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নিজেই রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন। এর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দল আন্দোলন শুরু করে। একপর্যায়ে এক-এগারোর পটপরিবর্তনের মধ্যদিয়ে সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্টতা নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে জিল্লুর রহমান রাষ্ট্রপতি হন। তিনি তাঁর মেয়াদ শেষ করার আগেই মারা যান। এরপর অস্থায়ী ও নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদ গতকাল সোমবার পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতির বড় একটা সময় কেটেছে হত্যা, ক্যু আর স্বৈরশাসনে। ১৯৯০–এর পরবর্তী সময় নির্বাচনের মাধ্যমে পাঁচ বছর অন্তর অন্তর বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শাসন বদল হয়েছে। ফলে বেশি সময় কোনো দলের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনের সুযোগ ছিল না। আর প্রতিবারই প্রতিপক্ষ দলের সরকারের সময় রাষ্ট্রপতিকে বিদায় নিতে হয়েছে। বি চৌধুরী নিজ দলের ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন। ২০০৯ সালের পর আওয়ামী লীগ টানা ক্ষমতায় রয়েছে। ফলে বঙ্গভবন থেকে আবদুল হামিদের বিদায় নিজ দলের সরকারের সময় আনুষ্ঠানিকভাবে হয়েছে।