ঢাকাবৃহস্পতিবার , ৬ এপ্রিল ২০২৩
  • অন্যান্য

বঙ্গবাজারের বাতাসে এখন শুধু পোড়া কাপড়ের গন্ধ

অনলাইন ডেস্ক
এপ্রিল ৬, ২০২৩ ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ । ১২৩ জন
বাতাসে এখন শুধু পোড়া কাপড়ের গন্ধ

রাজধানীর পুরান ঢাকার বঙ্গবাজার। প্রতিদিনের মতো গত সোমবার রাতেও দোকান বন্ধ করে বাসায় গিয়েছিলেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। কিন্তু পরদিন ভোর ৬টার দিকে হঠাৎ করেই ওই বাজারে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে। নিঃস্ব হয়ে যান কয়েক হাজার ব্যবসায়ী। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের অভিযোগ- পরিকল্পিতভাবে এই অগ্নিকান্ড ঘটানো হয়েছে। যদিও এই অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

আদর্শ হকার্স মার্কেট, মহানগর ও বঙ্গ গুলিস্তান-এই তিন অংশ মিলেই বঙ্গবাজার মার্কেট। প্রায় ২২ হাজার বর্গফুটের এই মার্কেটে ৫ হাজারের বেশি ছোট-বড় দোকান ছিল। তবে মঙ্গলবারের আগুনে এখানকার সব দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ফলে পুরো বঙ্গবাজার এলাকায় আগে যেখানে নতুন কাপড়ের ঘ্রাণ পাওয়া যেত, সেখানে এখন বাতাসে ভাসছে পোড়া গন্ধ।

বুধবার (৫ এপ্রিল) সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, আগুনে সবকিছুই পুড়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এ সময় পুড়ে ছাই হওয়া স্তূপের পাশেই বসে কান্না করতে দেখা যায় অনেককেই। আবার কাউকে কিছু পাওয়ার আশায় ছাইয়ের মধ্যেই হাতড়াতে দেখা যায়। তাদের একজন রায়হান আহমেদ। তিনি জানান, দীর্ঘদিন থেকেই বঙ্গবাজারে বাবার সঙ্গে ব্যবসা করে আসছিলেন। প্রতিদিনের মতো সোমবার রাতে দোকান বন্ধ করে তারা বাসায় ফেরেন। এরপর মঙ্গলবার সকালে আগুনের খবর পান। পরে দ্রুত বঙ্গবাজারে ছুটে আসলেও ভয়াবহ আগুনের হাত থেকে কিছুই রক্ষা করতে পারেননি।

আমাদের চোখের সামনেই আমাদের স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এটা কোনভাবেই সহ্য করা যায় না। আমাদের দোকানে প্রায় ৩০ লাখ টাকার মালামাল ছিল। মুহূর্তের মধ্যে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মোজাম্মেল নামে আরেক ব্যবসায়ী বলেন, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের দোকানটি পুড়তে দেখেছি। দোকান থেকে একটা সুতা পরিমাণ জিনিসও বের করতে পারি নাই। খুব অল্প সময়ের মধ্যে মার্কেটটি পুড়ে ছাই হয়। ভয়াবহ এই অগ্নিকান্ড পরিকল্পিত হতে পারে বলেও সন্দেহ করেন তিনি।

লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা মিজানুর রহমান বলেন, অনেকদিন থেকে এই মার্কেটে ব্যবসা করছি। কিন্তু আগুনে পুড়ে সব ছাই হয়ে গেছে। আগে দোকানে আসলে নতুন কাপড়ের গন্ধ পাওয়া যেত। বুধবার পোড়া দোকানে এসে দাঁড়িয়ে আছি। এখন শুধু পোড়া গন্ধ ছাড়া আর কিছুই নেই। এখন আমি কি করব? কোথায় যাব? রায়হান-মোজাম্মেল-মিজানুরের মতো বঙ্গবাজারের কয়েক হাজার ব্যবসায়ীর অবস্থা এখন একই। কীভাবে বড় এই ধাক্কা সামলে উঠবেন- এমন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ব্যবসায়ীদের মাথায়।

এনেক্সকো মার্কেটের চার তলার রকি স্টলের মালিক গোলাম মুস্তফা বলেন, আমার ১০ লাখ টাকার মাল বেঁচে গেছে। এখনও বের করা শেষ হয়নি। বের করে রাস্তার পাশেই রাখছি। বস্তায় পানি ঢুকছে, মালামাল কতটুকু ভালো আছে বস্তা খুলে পরে বোঝা যাবে। এতগুলো মালামাল এখন কোথায় রাখবো? বিভিন্ন জেলা থেকে যে ব্যবসায়ীরা আসত তারা এখন আসবে না। এখন আবার এই মার্কেটে ফিরে আসতে পারবো কি না জানি না।

দুই ভাই তোয়া ফারুকী ও ইমন ২০০৪ সালে লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ থেকে রাজধানীর বঙ্গবাজার এসেছিলেন সংসারের হাল ধরতে। প্রথমে দুই ভাই বঙ্গবাজারে কাঠের মার্কেটে দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে ২০১৫ সালে ‘পলক কালেকশন’ নামে ছোট একটি দোকান নিয়ে নিজেরাই ব্যবসা শুরু করেন। তারা বিক্রি করতেন মেয়েদের ওয়ান পিস কাপড়। ঈদকে সামনে রেখে স্বজনদের কাছ থেক ১৫ লাখ টাকা ধার করে একটু বেশি করে মাল তুলছিলেন এবার। আগুনে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন তারা।

দুই ভাইয়ের একজন ইমন বলেন, গত জানুয়ারি মাসে দোকান মালিককে এক বছরের জন্য আট লাখ টাকা ভাড়া দিয়েছি। ঈদের জন্য ১৫ লাখ টাকার নতুন কাপড় তুলেছিলাম। আমার সব কিছু পুড়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। দোকানের চাবিটি শুধু আমার হাতে আছে। এছাড়া সব আমার শেষ। কোন সহায়তা পাবো কি না এ বিষয়ে এখনও কোন আশ্বাস আমরা পাইনি। করোনার সময় থেকে আমরা ঋণগ্রস্ত। আমাদের জীবন শেষ। আমাদের সামনে স্বপ্নের বঙ্গবাজার পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

ইমন আরও বলেন, মা-বা স্বজনদের নিয়ে সুন্দরভাবে ঈদ পালনের ইচ্ছে ছিল। সে ইচ্ছে আর পূরণ হলো না। আমাদের এখন একটি আবেদন, আমরা আবার এ জায়গায়ই ব্যবসা শুরু করতে চাই। এনেক্সকো টাওয়ারের আরেকজন ব্যবসায়ী করিম খান। বেঁচে যাওয়া মাল ফিরে পেতে পাগলপ্রায় দশা তার। উপর থেকে মাল নামাতে হাঁপিয়ে উঠচ্ছেন বার বার। তিনি বলেন, আমার দোকান পাঁচ তলায়। ৫০ লাখ টাকার মাল ছিল আমার দোকানে। সবই বাচ্চাদের পোশাক। অর্ধেকের বেশি নষ্ট হয়ে গেছে। এখন যেটুকু পারি নামানোর চেষ্টা করছি। আমার আত্মীয়স্বজনের পাঁচটি দোকান পুড়েছে। কম হলেও তাদের ৫০ কোটি টাকার মালামাল নষ্ট হয়েছে। এখন আমাদের দাবি একটাই। নতুন করে ব্যবসায় ফিরতে চাই। এজন্য সরকারের কাছে সহযোগিতা চাই।

কাঠের মার্কেটের ‘মামুনা গার্মেন্টসের’ মালিক মো. সাদ্দাম হোসেন, তিন মাস আগে ভাইবোন ও স্বজনদের কাছে ধার করে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। আগুন লাগার দুই দিন আগেও মাকে ফোন করে বলেছি, ঈদের পর কিছু দেনা পরিশোধ করে দেবো। ওই দেনা পরিশোধ করার পথ আজ বন্ধ হয়ে গেছে। দোকানের বাক্সে থাকা ৫০ হাজার টাকার পোড়া ব্যান্ডিল আর পোড়া কাগজপত্র নিয়ে রাস্তা রাস্তায় হাঁটছিলেন আর কাঁদছিলেন সাদ্দাম। তিনি বলেন, আমার ব্যবসা পোড়েনি, আমার জীবনও পুড়ে গেছে। আমার মা অসুস্থ। মাকে বলছিলাম চিন্তা করো না, আমি উঠে দাঁড়াচ্ছি।

বঙ্গবাজার কাঠের মার্কেটের মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের কাছে লোক পাঠায়েছেন। তারা এসে আমাদের কাছে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা চেয়েছেন। আমরা এ বিষয়ে একটি বৈঠক করবো। এরপর আমরা তাদের তালিকা দেবো। সরকার থেকে যে ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসনের কথা বলা হচ্ছে সেই সহায়তা কি শুধু মার্কেট মালিকদের দেয়া হবে, নাকি ব্যবসায়ীরাও পাবেন এমন প্রশ্নের উত্তরে সমিতির সাধারণ সম্পাদক বলেন, মালিক-ব্যবসায়ী যারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সবাইর তালিকা আমরা দেবো। বাকিটা সরকারের সিদ্ধান্ত।

এদিকে বঙ্গবাজারে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সহায়তা দিতে তাদের তালিকা তৈরি করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। বুধবার বিকেলে ঢাকা দক্ষিণের নগর ভবনে বঙ্গবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কেটগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে এ তথ্য জানিয়েছেন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৫ হাজারের মতো বলে একটি হিসাব দিয়েছে ডিএসসিসি। ক্ষতিগ্রস্ত এই ব্যবসায়ীদের সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের নিজস্ব তহবিল হতে অনুদান দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন মেয়র তাপস।

এদিকে, বুধবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বঙ্গবাজারে লাগা আগুন নেভেনি। এখনও ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আগুন নেভানোর জন্য কাজ করছে। পুরোপুরি আগুন না নিভলে কাজ চলমান থাকবে বলেও জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, বঙ্গবাজার মার্কেটের উত্তরে থাকা এনেক্সকো ভবন থেকে এখনও ধোঁয়া বের হচ্ছে। ভবনটির ৫ ও ৬ তলায় আগুন আছে। আগুন নেভানোর জন্য পানি দিলেও পরে আবারও ধোঁয়া বের হচ্ছে।

এর আগে মঙ্গলবার ভোর ৬টার দিকে গুলিস্তানের বঙ্গবাজারে ভয়াবহ এই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এর পাশেই ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর হওয়ায় সকাল ৬টা ১০ মিনিটের দিকে আগুনের খবর পেয়ে দুই মিনিটের মাথায় ৬টা ১২ মিনিটের দিকে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় প্রথম ইউনিট। পরে পানির সংকট ও তীব্র বাতাসের ফলে তীব্রতা বাড়ায় আগুন নেভাতে বেশ বেগ পেতে হয়। এক পর্যায়ে ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিটের আপ্রাণ চেষ্টায় ওইদিন দুপুর ১২টা ৩৬ মিনিটের দিকে (সাড়ে ৬ ঘণ্টা পর) নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন।