দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারী। চলতি বৎসর ২৫ শে জানুয়ারী , বুধবার এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। এর আগে কমিশন সভা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে রাষ্ট্রপতি ও সংসদীয় উভয় ব্যবস্থার কারণে বহুবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের দ্বিতীয় তফসিল অনুসারে, সংসদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতেন একটি গোপন ভোটে। পরে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী অনুসারে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রত্যক্ষ নির্বাচন পদ্ধতির বিধান চালু করা হয়। তবে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর পরেই সংসদীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পর পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান চালু করা হয়েছিল। সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বর্তমানে সংসদ সদস্যদের দ্বারা পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
বাংলাদেশের সংবিধান ব্যক্তির রাষ্ট্রপতি হওয়ার যোগ্যতা নির্ধারণ করেছে। রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য এই মানদন্ডগুলি অবশ্যই মেনে চলতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচনের যোগ্য হতে পারবেন না যদি তারা:
বয়স পঁয়ত্রিশ বছরের কম; বা
সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচনের যোগ্যতা অর্জন করেননি; বা
এই সংবিধানের অধীনে অভিশংসনের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে সরানো হয়েছে
রাষ্ট্রপতি তার পদে প্রবেশের তারিখ থেকে পাঁচ বছরের জন্য মেয়াদে দায়িত্ব পালন করবেন। তবে শর্ত থাকে যে তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও রাষ্ট্রপতি তাদের উত্তরসূরি অফিসে প্রবেশ না করা অবধি পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন।কোনও ব্যক্তি দু’বারের অধিক মেয়াদে রাষ্ট্রপতির পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন না, এটি পরপর হোক বা না হোক।রাষ্ট্রপতি স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে একটি চিঠি লিখে পদত্যাগ করতে পারেন।
রাষ্ট্রপতি তাদের কার্যকালীন সময় সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচনের জন্য যোগ্য নন এবং সংসদের কোনও সদস্য রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হলে তারা রাষ্ট্রপতির পদে প্রবেশের দিন সংসদে তাদের আসন খালি ঘোষণা করবেন।
যখনই রাষ্ট্রপতি পদ শূন্য হয়ে যায়, নতুন রাষ্ট্রপতি সংসদ সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হন। যদিও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এমপিদের কাছ থেকে প্রকৃত ভোটদানের সাথে জড়িত, তারপরও তাদের মধ্যে সর্বসম্মতভাবে নিজ নিজ দল-সমর্থিত প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে বৈধ অভিযোগ আনা হলে এবং সংসদের দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি ভোটের সমর্থন পেলে তাকে অভিশংসন করা যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে এগারোটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে তিনটি সরাসরি নির্বাচন ছিল। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৪ সালে, সংসদের স্পিকার মোহাম্মদ মোহাম্মদউল্লাহ নির্বাচনের মাধ্যমে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন। রাষ্ট্রপতি সরকার প্রবর্তনের আগে তিনিই প্রথম রাষ্ট্রপতি যিনি নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছিলেন। নির্বাচনটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২৪ জানুয়ারী ১৯৭৪ সালে। নির্বাচনে সংসদ সদস্যরা তাকে সর্বসম্মতভাবে নির্বাচিত করেন।
পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, সাধারণ ভোটারদের অংশগ্রহণে ১৯৭৮ সালের ৩ জুলাই প্রথম সরাসরি বা গণ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১১ জন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য তাদের মনোনয়নপত্র জমা দেন। প্রাথমিকভাবে ২টি মনোনয়নপত্র অনুমোদন করা হয়নি। পরে দুই জন অযোগ্য প্রতিযোগীর একজনের আবেদন গৃহীত হলে প্রতিযোগী সংখ্যা ১০ জনে বৃদ্ধি পায়। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সেই নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
দ্বিতীয়বারের মতো সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ১৯৮১ সালের ১৫ নভেম্বর একইভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নির্বাচনের ৮৩ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। ১১ টি মনোনয়নপত্র বাতিল করা হয়। বৈধ প্রার্থীদের সংখ্যা কমে ৭২ জন হয়। পরে, ৭২ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩৩ জন প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে নিলেন প্রতিযোগীর সংখ্যা হয় ৩৯ জন। ওই নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন বিচারপতি আবদুস সাত্তার।
১৯৮৬ সালের ১৫ অক্টোবর তৃতীয় সরাসরি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই নির্বাচনে ১৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন, তবে চার প্রার্থীর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পরে মোট প্রতিযোগীর সংখ্যা বারো জন হয়ে যায়। উল্লেখযোগ্যভাবে প্রধান বিরোধী দলগুলি, যারা সামরিক আইন তুলে নেওয়র দাবি করেছিল, তারা এই নির্বাচনগুলি বয়কট করেছিল। দাযয়িত্বপ্রাপ্ত লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ যিনি তার নেতৃত্বাধীন সামরিক অভ্যুত্থানের পরে ৩ বছর আগে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন, সেই নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ সত্ত্বেও তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হযয়েছিলেন।
১৯৯১ সালে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পূনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়। সংসদীয় ব্যবস্থা পুনপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সংসদ সদস্যদের দ্বারা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়। ১৯৯১ সালের পর যারা রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তারা হলেন আবদুর রহমান বিশ্বাস, বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, জিল্লুর রহমান এবং আব্দুল হামিদ। তাদের সবাই-ই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নির্বাচনী কর্তা হিসেবে দায়িত্ব¡ পালন করবেন সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, আগ্রহী প্রার্থীরা আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন।
১৩ ফেব্রুয়ারি যাচাই-বাছাইয়ের পর ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা যাবে। নির্বাচনী কর্তার কার্যালয়ের (প্রধান নির্বাচন কমিশনারের অফিসে নির্ধারিত দিনে অফিস চলাকালে) মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে।
এ নির্বাচনে ভোটার হচ্ছেন সংসদ সদস্যরা। ভোটার ৩৪৩ জন সংসদ সদস্য।ভোটের জন্য জাতীয় সংসদের একটি বৈঠক ডাকা হয়। আর একক প্রার্থী হলে আইন অনুযায়ী তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। সে ক্ষেত্রে সংসদের বৈঠকের প্রযয়োজন হয় না। সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর দেশে এখন পর্যন্ত একবারই রাষ্ট্রপতি পদে ভোটাভুটির প্রযয়োজন পড়েছিল।
সংবিধানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ অবসানের কারণে এ পদ শূন্য হলে মেয়াদ সমাপ্তির তারিখের আগের ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে শূন্য পদ পূরণের জন্য নির্বাচন হবে।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দ্বিতীয় দফায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন মো. আবদুল হামিদ। আগামী ২৩ এপ্রিল শেষ হবে তাঁর শেষ মেয়াদ। তবে সংবিধান অনুযায়ী, ২৩ ফেব্রুয়ারীর মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে।