বন্যার পানি সরে যাচ্ছে দ্রুত। বেরিয়ে আসছে ক্ষত। তৃণলতা, গুল্ম ও বীরুৎ–জাতীয় উদ্ভিদের আবাসস্থল নষ্ট হয়ে গেছে। মাটির নিচে থাকা মোথা বা শিকড় থেকে কিছু উদ্ভিদ মাথা তুলে দাঁড়াবে। বড় অনেক গাছ পানিতে ডুবে নির্জীব হয়ে গেছে। এর মধ্যে অনেক গাছই শুকিয়ে মারা যাবে। কিছু গাছ হেলে পড়েছে, ভেঙে গেছে। সেগুলোরও ক্ষতি হবে।
বন্যায় বৃক্ষের দুই ধরনের ক্ষতি হয়েছে—শারীরিক ও শারীরবৃত্তীয়। বৃক্ষের প্রজাতি, গাছের স্বাস্থ্য, বছরের বন্যার সময়, বন্যার ঘটনার দৈর্ঘ্য, জলের গভীরতা এবং গাছের শিকড় থেকে সরে যাওয়া মাটি বা জমা হওয়া পলির পরিমাণ ইত্যাদি নির্ণয়ের মাধ্যমে গাছের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা যায়।
প্রবল বন্যার পানি গাছের গুরুতর শারীরিক ক্ষতি করে। গাছের কাণ্ড থেকে শাখা-প্রশাখা ভেঙে ছাল বের হয়ে যায়। পানি গাছের শিকড়ের চারপাশে মাটি ক্ষয় করে, যার ফলে গাছের শিকড় স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে না। বন্যার পানির তোড়ে গাছ সহজেই মাটি থেকে উপড়ে যায়।
বন্যার পানি সরে গেলে আঞ্চলিক ভিত্তিতে গাছে ঝুলে থাকা ভাঙা শাখা কেটে সরিয়ে দিতে হবে, হেলে পড়া গাছ যতটুকু সম্ভব সোজা করে দিতে হবে। গাছের বাকলের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হলো কি না, দেখতে হবে। হেলান দেওয়া গাছ যদি সোজা করা কঠিন হয়, তাহলে কেটে ফেলতে হবে। না হলে পরে গিয়ে জানমালের ক্ষতি করতে পারে।
বন্যার পানি দ্বারা মাটি ক্ষয় হয়ে বা মাটি সরে গিয়ে গাছের শিকড় উন্মুক্ত হতে পারে। যদি গাছটি এখনো দাঁড়িয়ে থাকে এবং শক্তভাবে শিকড়যুক্ত বলে মনে হয়, সেগুলোকে ঢেকে দেওয়ার জন্য শিকড়ের চারপাশে মাটি দিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে কোনো ফাঁক না থাকে। তবে গাছের শিকড়ের ওপর অতিরিক্ত মাটি দেওয়া যাবে না।
বন্যার সময় গাছ প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পায় না এবং মূলতন্ত্রের ওপর প্রচুর মাটি জমে। অক্সিজেনের অভাবের কারণে শিকড়গুলো কার্যকারিতা হারিয়ে বৃদ্ধি বন্ধ করে দেয় এবং অবশেষে শিকড়ের মৃত্যু ঘটে। ভারী কাষ্ঠল শিকড়ের তুলনায় হালকা কাষ্ঠল শিকড়ের বন্যা থেকে বাঁচার সম্ভাবনা বেশি। শিকড়ের মৃত্যু ঘটলে রোগ সৃষ্টিকারী ছত্রাক সহজেই শিকড়কে আক্রমণ করতে পারে। এর ফলে উদ্ভিদ রোগাক্রান্ত হয় এবং গাছ উপড়ে পড়ে যেতে পারে।
বন্যা মাইকোরাইজাল ছত্রাকের বৃদ্ধিকেও দমন করে, যেগুলো ভালোভাবে বেড়ে উঠতে মাটিতে উচ্চমাত্রার অক্সিজেন প্রয়োজন। মাইকোরাইজাল ছত্রাক মাটিতে উপকারী জীব যা গাছের শিকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে এবং গাছের মূল নেটওয়ার্ক এবং পুষ্টি গ্রহণকে ব্যাপকভাবে প্রসারিত করে।
বন্যার পরে গাছের মূলতন্ত্রের ওপর কয়েক ফুট বালি, পলি বা কাদামাটি জমা হয়, মূল চলে যায় মাটির গভীরে। এর ফলে মূলে দীর্ঘমেয়াদি অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হয়। কিছু গাছে জমে থাকা মাটির ওপরের স্তরগুলোতে নতুন শিকড় তৈরি হতে পারে, তবে অন্য গাছগুলো অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়।
এ ক্ষেত্রে বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গাছের নিচে জমে থাকা জমা মাটি যতটা সম্ভব সরিয়ে আসল মাটির মতো পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে। মাটি সরে বেরিয়ে যাওয়া শিকড়ের ওপর পলিমাটি জমলে তা এমনভাবে সরাতে হবে, যাতে শিকড়ের কোনো ক্ষতি না হয়। এই কাজ করতে হবে সাবধানে এবং দ্রুত।
প্লাবিত গাছের গোড়া পরিষ্কার করে পানি দিয়ে ধুয়ে দিতে হবে। সম্ভব হলে চারা ও ছোট গাছের পাতায় জমে থাকা পলিমাটি পানি স্প্রে করে ধুয়ে দিতে হবে, কিছু শাখা-প্রশাখা ও পাতা ছেঁটে দিতে হবে। যে জায়গাগুলো ধুয়ে ফেলা হয়েছে, সেখানে খড়, কচুরিপানা, শুকনা ঘাস, কম্পোস্ট ইত্যাদি দিয়ে মালচিং করে বা ঢেকে দিলে ভালো হয়।
মাটিতে যাতে বায়ু চলাচল করতে পারে, অক্সিজেন প্রবেশ করতে পারে, সে জন্য গাছের গোড়ার মাটি কিছুটা কুপিয়ে আলগা করে দিতে হবে। বাগানে বা গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে নিকাশ নালা কেটে দ্রুত তা সরানোর ব্যবস্থা করতে হবে। মাটিতে ছিদ্র করতে হবে, কেটে দিতে হবে।
গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে মানুষ ভেসে যাওয়া ঠেকিয়েছে। পাখি, সাপ, বেজি, গুইসাপ ইত্যাদি প্রাণী আশ্রয় পেয়েছে গাছে। তাই বন্যাপ্লাবিত অঞ্চলে প্রচুর মাটি ও জলবায়ু উপযোগী বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। বন্যাপ্রবণ স্থানে গাছ লাগানো বা প্রতিস্থাপন করার সময় এমন গাছের প্রজাতি বেছে নিতে হবে, যেগুলো জলমগ্নতা সহনশীল, শক্ত ও দীর্ঘজীবী। বন্যার পর অন্যান্য সম্পদের যত্নের পাশাপাশি গাছপালার যত্নও নিতে হবে। মনে রাখতে হবে—গাছপালা শুধু আপনার সম্পদ নয়, গোটা পৃথিবীর সম্পদ।