ঢাকাবৃহস্পতিবার , ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
  • অন্যান্য

ঢাকার বাইরে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় নাজুক অবস্থা

অনলাইন ডেস্ক
সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৩ ১১:৩৩ পূর্বাহ্ণ । ৬৪ জন

দেশে প্রতিবছর গড়ে প্রায় পৌনে তিন লাখ মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ব্যয়বহুল চিকিৎসা নিয়ে কোনোরকমে বেঁচে যান কয়েক লাখ মানুষ। ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল মিলে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের ব্যয়বহুল চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও ঢাকার বাইরের অবস্থা খুবই নাজুক। সরকারিভাবে শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও বেসরকারিভাবে চারটি হাসপাতালে কাডিয়াক সার্জারির ব্যবস্থা রয়েছে।

সারা দেশে হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীর অস্বাভাবিক চাপ বাড়ছে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে। এখানে চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। আবার উচ্চবিত্তদের বড় একটি অংশ ছুটে যান বিদেশে। দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পেয়ে হৃ দরোগে আক্রান্ত অন্তত পৌনে তিন লাখ মানুষ মারা যান। এমন এক বাস্তবতায় আগামীকাল (শুক্রবার) সারা বিশ্বের মতো দেশেও পালিত হবে বিশ্ব হার্ট বা হৃ দরোগ দিবস-২০২৩। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য, ‘ইউজ হার্ট, নো হার্ট’। দিবসটি উপলক্ষ্যে হৃ দরোগ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরিতে সরকারি-বেসরকারিভাবে বেশ কিছু কর্মসূচি পালিত হবে।

গত ১৭ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে বুকের বামপাশে প্রচণ্ড ব্যথায় শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় কুমিল­ার বরুড়া উপজেলার কুদ্দুছ আলীর। এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। তাকে দ্রুত নেওয়া হয় স্থানীয় ক্লিনিকে। সেখানে অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় কুমিলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর হার্টের দুটি ব্লক ধরা পড়ে।

চিকিৎসকরা তাকে পেসমেকার বসানোর পরামর্শ দেন। কিন্তু কুমিলার কোথাও পেসমেকার বসানোর চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকায় তাকে রাজধানীর জাতীয় হৃ দ?রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর তার পেসমেকার বসানো হয়। এতে তার খরচ হয়েছে ১ লাখ ৭০ হাজার। প্রায় এক মাস ধরে তিন হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি, বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ওষুধপত্রসহ মোট তার প্রায় তিন লাখ খরচ হয়েছে। এখন ধারদেনা করে চিকিৎসা চলছে বলেও জানান কুদ্দুছ আলীর পুত্রবধূ পারভীন আক্তার। আব্দুল কুদ্দুসের মতো হাজার হাজার রোগী ঢাকার বাইরে হৃদরোগের চিকিৎসা সুবিধা না পেয়ে ঢাকায় এসে বহু কষ্টসাধ্যে কোনোমতে একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন।

এর পেছনে সবাইকেই মোটা অঙ্কের অর্থও ব্যয় করতে হয়। ঢাকার বাইরে বেসরকারিভাবে কার্ডিয়াক সার্জারি হয় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতাল, ইমপেরিয়াল হাসপাতাল ও এভারকেয়ার হাসপাতালে। সিলেট ও সিরাজগঞ্জে রয়েছে এই সার্জারির ব্যবস্থা। এছাড়া সরকারিভাবে পুরাতন আট মেডিকেল হাসপাতালে কার্ডিয়াক ইন্টারভেনশনের ব্যবস্থা রয়েছে।

এগুলো হলো- রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা আবু নাসের মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, দিনাজপুরে এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বগুড়ায় শহীদ জিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। বেসরকারিভাবে দিনাজপুরে জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন ও সিলেটে একটি বেসরকারি হাসপাতালে এ ব্যবস্থা রয়েছে।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের পরিসংখ্যান বিভাগ সূত্রে জানা যায়, হৃ দরোগ চিকিৎসায় দেশের একমাত্র সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল এটি। ২০২০ সালে ১ হাজার ২৫০ শয্যার হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে ৯৫ হাজার ২৪ জন ও বহির্বিভাগে ১ লাখ ৩৮ হাজার ৭৯৬ রোগী চিকিৎসা নেন।

২০২১ সালে এই সংখ্যা বেড়ে জরুরি বিভাগে ১ লাখ ১৫ হাজার একজন এবং বহির্বিভাগে ১ লাখ ৫০ হাজার ৪৯৯ জন হয়। পরের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে রোগী আরও বেড়ে জরুরি বিভাগে ১ লাখ ৩১ হাজার ৯০৩ জন এবং বহির্বিভাগে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৬৪৮ জন হয়। সবশেষ চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত জরুরি বিভাগে ৯৬ হাজার ৯৭ জন, বহির্বিভাগে ১ লাখ ৩২ হাজার ৪১৩ জন চিকিৎসা নিয়েছেন।

এছাড়া এ সময় আন্তঃবিভাগে ভর্তি হয়েছেন ৬৩ হাজার ৬১১ জন ও চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে ৫১১ জন হৃ দরোগী।

অন্যদিকে হাসপাতালটিতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৪৬২ জনকে ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৩০ জনকে সিএবিজি, ১৪০ জনের হার্টে ভাল্ব প্রতিস্থাপন, ১৬৯ জনের কনিজেটিনাটল (হার্টের জš§গত ত্র“টি) অস্ত্রোপচার ও ২৩ জনকে হার্টের অন্যান্য অস্ত্রোপচার করা হয়। এ সময় ২৮ জনের ক্লোজ হার্ট সার্জারি ও ১ হাজার ১০৪ জনের ভাস্কুলার সার্জারিসহ মোট ১ হাজার ৫৯২টি সার্জারি হয়েছে।

এছাড়া জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৫ হাজার ৪৯৯টি করোনারি এনজিওগ্রাম, ২ হাজার ৪৩২টি পিসিআই, ৬৭টি পি.পিসিআই, ৩৭টি পিটিএমসি, ১৮টি সি ক্যাথ পরানো হয়। এর বাইরে হার্টের ছোটখাটো অস্ত্রোপচারসহ মোট ক্যাথ ল্যাব জোনে ১ হাজার ১৫১টি অস্ত্রোপচার করা হয়।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের ইপিডেমিওলজি অ্যান্ড রিসার্চ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, দেশে অসংক্রামক রোগ বেশি হচ্ছে। এর মধ্যে হৃ দরোগ, স্ট্রোক ও সেরিব্রো কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজ, ক্যানসার, ডায়াবেটিস ও সিওপিডি বা দীর্ঘমেয়াদে শ্বাসকষ্ট রোগ বাড়ছে।

এর মধ্যে কার্ডিওভাস্কুলার রোগে সবচেয়ে অর্থাৎ ৩০ শতাংশ রোগী মারা যাচ্ছে। দেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ মানুষ অসংক্রামক রোগে মারা যায়। এর মধ্যে ২ লাখ ৭৩ হাজার মারা যাচ্ছে কার্ডিওভাস্কুলার ডিজিজে। এর মধ্যে ১৯ শতাংশের মৃত্যু হচ্ছে অকাল মৃত্যু বা ৭০ বছরের নিচে। যার অন্যতম কারণ হৃ দরোগ।

জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীর জামাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, হৃদরোগের বড় কারণ হচ্ছে তামাকের ব্যবহার, কায়িক পরিশ্রম না করা, অস্বাস্থ্যকর চর্বি, ক্যালরিযুক্ত খাদ্যগ্রহণ ও লবণ বেশি খাওয়া এবং ওজন বেড়ে যাওয়া। এতে উচ্চ রক্তচাপ অথবা ডায়াবেটিস হচ্ছে।

যাদের এই রোগ হচ্ছে তাদের ইস্কেমিক হার্ট ডিজিজ বেশি হচ্ছে। যারা ধূমপান করছে তাদের এই ঝুঁকি দ্বিগুণ হচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্তদের হার্ট ফেইলিউর, হার্ট অ্যাটাক চার থেকে দশগুণ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। যা অকাল মৃত্যুর বড় কারণ হিসাবে দেখা দিচ্ছে। তামাক-উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃ দরোগ প্রতিরোধে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।