ঢাকাবৃহস্পতিবার , ২৪ আগস্ট ২০২৩
আজকের সর্বশেষ সবখবর

এক নারী কর কর্মকর্তার জীবনের ভয়ংকর ১৮ ঘণ্টা

অনলাইন ডেস্ক
আগস্ট ২৪, ২০২৩ ১:১৪ অপরাহ্ণ । ৭৮ জন
সংগৃহীত ছবি:

সময় রাত আটটা। ঘটনাস্থল রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ৯ নম্বর ফটক। মাইক্রোবাসে করে মগবাজার থেকে সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় ফিরছিলেন যুগ্ম কমিশনার পদমর্যাদার একজন নারী কর কর্মকর্তা (৪৯)। কয়েকজন ব্যক্তি মাইক্রোবাস থামিয়ে চালককে মারধর শুরু করেন। একপর্যায়ে গাড়ি থেকে চালককে নামিয়ে মাইক্রোবাসসহ ওই নারীকে অপহরণ করেন তাঁরা।

এমন জনাকীর্ণ এলাকা থেকে এভাবে প্রকাশ্যে উচ্চপদস্থ একজন সরকারি কর্মকর্তাকে অপহরণের ১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত কোনো খোঁজ ছিল না। পরদিন বেলা দুইটার দিকে ওই নারী কৌশলে একটি গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার শুরু করলে স্থানীয় জনতা ঢাকার সবুজবাগ এলাকা থেকে তাঁকে উদ্ধার করেন। পাশাপাশি তিন অপহরণকারীকে আটকও করেন।

যখন ওই নারী কর্মকর্তাকে উদ্ধার করা হয়, তখন তাঁর বাঁ পা ভাঙা, চোখে ও মাথায় মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন। তিনি এখন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

নারী কর কর্মকর্তাকে অপহরণের ঘটনা ঘটে ১৭ আগস্ট রাতে। এ ঘটনায় তিনি ঢাকার রমনা থানায় চারজনের নাম উল্লেখ করে অপহরণ মামলা করেছেন। মামলার প্রধান আসামি করা হয়েছে মো. মাসুদ নামের এক ব্যক্তিকে, যিনি জুলাই মাসে ওই নারীর ব্যক্তিগত গাড়ির চালক ছিলেন। চলতি মাসের ১ তারিখে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

নারী কর কর্মকর্তার ভাষ্য, অপহরণকারীরা তাঁর কাছে কোনো মুক্তিপণ চাননি। অপহরণকারীদের মধ্যে শুধু মাসুদকে তিনি চিনতে পেরেছেন। ২০–২৫ দিন কাজ করার পর তাঁকে চাকরিচ্যুত করেছিলেন। এই ক্ষোভ থেকেই তাঁকে অপহরণ করা হয়। নির্মম নির্যাতনের সময় মাসুদ বারবার তাঁকে চাকরিচ্যুত করার কারণে ক্ষোভের কথাই বলছিলেন। মাসুদ আগেও মুঠোফোনে তাঁকে এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিয়েছিলেন। তবে শুধু চাকরিচ্যুত করায় মাসুদ কেন এতটা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, সেটি তিনি বুঝতে পারছেন না।

নারী কর কর্মকর্তা বলেন, মাসুদ শুধু নির্মমভাবে নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হননি। তাঁকে হত্যার পরিকল্পনাও করেছিলেন। সেই কথাও নির্যাতনের সময় বারবার বলছিলেন মাসুদ। রাতভর গ্যারেজে আটকে রেখে পরদিন গাড়িতে করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যার পর বস্তাবন্দী করার কথাও বলছিলেন মাসুদ। দুপুরের পর অপহরণকারীরা খাবার কিনতে গেলে কৌশলে গাড়ি থেকে নেমে চিৎকার শুরু করলে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসেন। তাঁরাই তিনজন অপহরণকারীকে আটক করেন। তবে মাসুদ তখন পালিয়ে যান।

নারী কর কর্মকর্তার পারিবারিক সূত্র জানায়, গাড়িচালক মাসুদকে চাকরিচ্যুত করার কারণে এমন ঘটনা ঘটেছে, সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। যেভাবে তিনি মারধর করেছেন, হত্যার চেষ্টা করেছেন—এর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে। এ ঘটনার পেছনে ওই নারী ও তাঁর স্বামীর সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো বিরোধও থাকতে পারে। এই বিষয় নিয়ে বাড়াবাড়ি না করার জন্য ফোন করে ওই নারীর পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে বলেও পরিবারের সদস্যরা জানান। ওই নারীর তিন সন্তান রয়েছে।

নারী কর কর্মকর্তার পরিবারের একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন রাতে ওই নারীর মুঠোফোন থেকে তাঁর স্বামীকে ফোন করা হয়। তখন ওই নারী তাঁর স্বামীকে বলেন, তিনি একটি রিসোর্টে আছেন। স্বামীর জন্য অনলাইনে খাবারের অর্ডার দিয়েছেন তিনি। আবার ফোন করে ওই নারী তাঁর স্বামীকে বলেন, সকালে রিসোর্ট থেকে তাঁকে নিয়ে যেতে। পরে ফোন বন্ধ পেয়ে বিষয়টি পুলিশকে জানান তাঁর স্বামী। পাশাপাশি মুঠোফোনের অবস্থান শনাক্ত করে ওই নারীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন পরিবারের সদস্যরা।

পারিবারিক সূত্রের ভাষ্য, ওই নারীকে দেশীয় অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাঁর স্বামীকে ফোন করতে বলেন অপহরণকারীরা। ঘটনার দিন রাতে রমনা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গিয়েছিলেন ওই নারীর স্বামী। কিন্তু থানা-পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে জিডি নেয়নি। পরদিন দুপুর ১২টার দিকে পুলিশ জিডি নেয়।

রমনা থানার পুলিশ জানায়, নারী কর কর্মকর্তা এজাহারে ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছেন, প্রাথমিক তদন্তে এর সত্যতা মিলেছে। তবে মূল আসামি মাসুদ গ্রেপ্তার না হওয়ায় এর পেছনে কারা আছে, সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। স্থানীয় জনতা সাইফুল ইসলাম, আবু বকর সিদ্দিক ও ইয়াছিন আরাফাত ওরফে রাজু নামের তিনজনকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। তাঁরা মাসুদের সহযোগী। তিনজনেরই রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

মামলার তদন্ত করছেন রমনা থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সহিদুল ওসমান। তিনি  বলেন, গ্রেপ্তার তিনজনের বাসা সবুজবাগের দক্ষিণগাঁও এলাকায়। মাসুদও ওই এলাকায় বসবাস করেন। গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে ইয়াছিন শিক্ষার্থী, সাইফুল অটোরিকশার চালক এবং আবু বকর কোনো কাজ করেন না। অপহরণের পেছনে মূল ঘটনা কী, সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

নির্মম নির্যাতন করা হয়
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৮ আগস্ট তাঁকে উদ্ধারের পর পুলিশ ওই নারীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে তাঁকে নেওয়া হয় মগবাজারের একটি হাসপাতালে। আঘাত গুরুতর হওয়ায় পরে অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়। তিন হাসপাতাল ঘুরে এখন তিনি কলাবাগানের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

পারিবারিক সূত্র জানায়, ওই নারী কর্মকর্তার আঘাত গুরুতর। পিটিয়ে তাঁর বাঁ পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি হাঁটাচলা করতে পারছেন না। তাঁর দুই চোখে একের পর এক আঘাত করা হয়েছে। এতে ডান চোখের ওপরের অংশ এবং নিচের অংশে ফুলে গেছে। অনেকটা অংশজুড়ে কালচে দাগ হয়ে গেছে। বাঁ চোখেও আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মাথায়ও একাধিক আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে।

বুধবার মুঠোফোনে ওই নারী কর কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি এখন খুবই অসুস্থ। অপহরণকারীরা নির্মমভাবে মারধর করেছে।’