সুযোগ কাজে লাগাতে চান প্রার্থীরা
আসন্ন ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচন চারটি ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী, আগামী ৮ মে প্রথম ধাপের ভোট অনুষ্ঠিত হবে। এবারের উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রতীক রাখছে না আওয়ামী লীগ।
ফলে আনুষ্ঠানিকভাবে দল থেকে কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে না। ভোটের ব্যালটেও থাকছে না নৌকা প্রতীক। তাই প্রতীক না থাকার এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছেন প্রার্থীরা।
আবার এই নির্বাচন বয়কট করেছে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপি। তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপির নেতারা ভোটে অংশ নিলেও প্রকাশ্যে দলের সমর্থন পাবেন না তাঁরা। তাই নির্বাচন জমজমাট করতে প্রার্থিতা উন্মুক্ত রেখেছিল আওয়ামী লীগ।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে দলের ঐক্য ঠিক রাখতে, দ্বিধাবিভক্ত ও মাঠের উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব বিস্তার কমাতে ‘স্বজন’ কোটার প্রার্থীদের সরিয়ে নিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
পাবনা-৩ আসনের এমপি মকবুল হোসেনের বড় ছেলে গোলাম হাসনাইন উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। তিনি ভাঙ্গুড়া পৌরসভার বর্তমান মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য গত সোমবার মেয়র পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন।
এখন নির্বাচন থেকে সরে যেতে রাজি নন গোলাম হাসনাইন। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমি প্রার্থী হতে চাইনি। কিন্তু নেতাকর্মীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে চার দিন আগে পৌরসভা থেকে পদত্যাগ করেছি। গত বুধবার আমার পদত্যাগপত্র সচিবালয়ে গৃহীত হয়। এখন জনগণের দাবিতেই নির্বাচন করা ছাড়া তো উপায় দেখছি না।’
‘নিজের যোগ্যতায় প্রার্থী হয়েছি’
কসবা উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে প্রার্থী হতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন মো. সায়েদুর রহমান। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনের এমপি এবং আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের ফুফাতো ভাই।
এক প্রশ্নের জবাবে সায়েদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি মন্ত্রীর আত্মীয় হিসেবে ভোটে অংশ নিইনি। আমি ৩০ বছর ধরে কুটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। কুটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলাম। আমি আমার অবস্থান থেকেই নির্বাচনে দাঁড়িয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘নিজের যোগ্যতায় প্রার্থী হয়েছি। আমি ভোটে লড়ব, এটা নিশ্চিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো এটা কোনো দলীয় নির্বাচন নয়।’
কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একই পদে ফের প্রার্থী হয়েছেন বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. আমিরুল ইসলাম। তিনি কুমিল্লা-৯ আসনের এমপি ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের ভাতিজা।
আবার লাকসামে ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান মহব্বত আলী। তিনি মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের শ্যালক।
নির্বাচনে থাকা বা সরে যাওয়া প্রসঙ্গে দুই প্রার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁদের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি সূত্র বলছে, মনোনয়ন বৈধ ঘোষণার পরের দিন দলের এমন নির্দেশনা জানা গেছে। মনোনয়ন দাখিলের আগে এমন নির্দেশনা এলে বিষয়টি নিয়ে বিকল্প চিন্তা করা সম্ভব হতো। এখন প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই।
নাটোরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে তৃতীয় ধাপে। এরই মধ্যে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কথা জানিয়েছেন নাটোর-নওগাঁ সংরক্ষিত আসনের এমপি কোহেলী কুদ্দুস মুক্তির ছোট ভাই আসিফ আব্দুল্লাহ বিন কুদ্দুস। গতকাল শুক্রবার তিনি কালের কণ্ঠকে এই তথ্য জানিয়েছেন।
গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুরাদ কবির নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি গাজীপুর-১ আসনের এমপি ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের মামাতো ভাইয়ের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে।
গতকাল উপজেলার তালতলি এলাকায় এক সভায় নির্বাচন করার ঘোষণা দেন তিনি। মুরাদ কবির বলেন, ‘এমপি-মন্ত্রীর স্বজন বলতে কাকে বুঝানো হয়েছে, তা আমার জানা নেই। এত দিন ধরে আওয়ামী লীগ করেছি আর এখন নির্বাচন করতে পারব না এটা হয় না। আমি নির্বাচন করব।’
লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনের এমপি আনোয়ার হোসেন খানের বড় ভাই আখতার হোসেন খান উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিষয়ে গতকাল তিনি জানিয়েছেন।
লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নের বোনের জামাতা মামুনুর রশিদ উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনী মাঠে রয়েছেন। এমনি নিজের পক্ষে দলের সমর্থন পেতে গতকাল তৃণমূলে বর্ধিত সভা ডেকেছেন। সেখানে নুর উদ্দিন নয়ন এমপিসহ অন্যরা একক প্রার্থীর বিষয়ে সিদ্ধান্তে একমত হয়েছেন।
নীলফামারী-১ আসনের এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা আফতাব উদ্দিন সরকারের চাচাতো ভাই মো. আনোয়ারুল হক সরকার এবং ভাতিজা মো. ফেরদৌস পারভেজ উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
জানতে চাইলে ফেরদৌস পারভেজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি অনেক আগে থেকে ভোটের মাঠে রয়েছি। ভোট তো আমি করব। আমি জেলা পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করে উপজেলা নির্বাচনে এসেছি। আমি দলের কোনো প্রার্থী নই, স্বতন্ত্র প্রার্থী। ভোট থেকে সরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
আনোয়ারুল হক সরকার বলেন, ‘গত উপজেলা নির্বাচনে মনোনয়ন চেয়েছি, এমপি নির্বাচনেও মনোনয়ন চেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দেননি। আমি দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছি। দল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এর মধ্যে আমি পড়ি না। কারণ আমার পরিবার আলাদা, আমি এমপির প্রার্থী নই।’
মুন্সীগঞ্জের সদর উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আনিছ উজ্জামান টানা চতুর্থবারের মতো এবার প্রার্থী হয়েছেন। সদরের নির্বাচনে তিনিই একমাত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী। কিন্তু ঋণখেলাপির অভিযোগে তাঁর মনোনয়নপত্র অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।
এ নিয়ে তিনি আপিল করেছেন। আপিলে প্রার্থিতার বৈধতা ফিরে পেলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি চেয়ারম্যান হতে চলছেন। আনিছ উজ্জামান মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের এমপি ফয়সাল বিপ্লবের আপন চাচা।
আনিছ উজ্জামান জানান, তিনি জেলা প্রশাসক ও জেলা রিটার্নিং অফিসারের কাছে আপিল করেছেন। তিনি কোনো ঋণখেলাপি নন। তিনি বলেন, ‘আমার ভাতিজা এমপি হয়েছেন। আমি এরই মধ্যে উপজেলায় মনোনয়ন জমা দিয়েছি। একমাত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ায় চাইলেও আমার সরে আসার সুযোগ নেই।’
যাঁরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তাঁরা ভোটে থেকে যেতে নানা ধরনের যুক্তি দিচ্ছেন। কিন্তু নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার ব্যাপরে দলীয় সিদ্ধান্তে নরম হচ্ছেন না। প্রথম ধাপের নির্বাচনে আগামী সোমবার পর্যন্ত প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সুযোগ রয়েছে। এরপর আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হবে। তবে রাজনৈতিক কৌশলে ভোটের আগে যেকোনো সময় প্রার্থীরা সরে যেতে পারেন—এমন ইঙ্গিতও আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে পাওয়া গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে দল তাঁদের বিরুদ্ধে সরাসরি ব্যবস্থা নিতে পারে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে দলের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের এক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ব্যবস্থা নিতে চাইলে দল নিতে পারবে। দলীয় প্রতীক নেই, তাই নির্বাচনে দাঁড়ানোটা দোষের নয়। এটা যেমন ঠিক, তেমনি দলের সভাপতির নির্দেশ মানাটা জরুরি। নেত্রীর (শেখ হাসিনা) নির্দেশ না মানার বিষয়টি দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের শামিল। তাই শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, প্রার্থীরা শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশ মেনে চলবেন। শাস্তির বিপরীতে পুরস্কারও রয়েছে। আজকের সিদ্ধান্ত ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।’
(প্রতিবেদনে নীলফামারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, দামুড়হুদা (চুয়াডাঙ্গা), ভাঙ্গুড়া (পাবনা), কালিয়াকৈর (গাজীপুর), গুরুদাসপুর (নাটোর) প্রতিনিধি তথ্য দিয়েছেন)