ঢাকাবুধবার , ১২ এপ্রিল ২০২৩
  • অন্যান্য

থেমে গেলো আরেক কিংবদন্তী ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

অনলাইন ডেস্ক
এপ্রিল ১২, ২০২৩ ৯:৫১ পূর্বাহ্ণ । ৯৫ জন
ছবি: সংগৃহীত

থেমে গেলো আরেকটি বিবেকি কণ্ঠ। চলে গেলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের আরো এক কিংবদন্তী। দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য মুক্তকণ্ঠ হয়ে উঠা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মঙ্গলবার রাত ১০টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার মৃত্যুতে শোকের ছাড়া নেমে এসেছে তার সকল মহলে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজন, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।

ডা. জাফরুল্লার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অধ্যাপক মামুন মোস্তাফি মঙ্গলবার রাতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হাসপাতালে এক সংবাদ সম্মেলনে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমকে জানান। স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত এই বীর মুক্তিযোদ্ধা দীর্ঘদিন থেকে নানা রোগে ভুগছিলেন। সপ্তাহে কয়েক দিন ডায়ালাইসিস নিতে হতো। এমন অবস্থায়ও বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে তিনি মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন। অনিয়ম অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

সর্বশেষ ২৬শে মার্চ বঙ্গভবনে আয়োজিত প্রেসিডেন্টের দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নেন হুইল চেয়ারে বসে। এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাশে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।

 

জাফরুল্লাহ চৌধুরী  মুক্তিযুদ্ধের সময় রণাঙ্গনে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে প্রাণ বাঁচিয়েছেন অসংখ্য আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধার। দেশ স্বাধীনের পর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে এর মাধ্যমে তিনি আজীবন মানুষের সেবা করে গেছেন। অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপন করে যাওয়া এই বীর মুক্তিযোদ্ধা কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না হলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিলেন এক সরব কন্ঠ। তিনি সাহসের সঙ্গে সরকাারি ও বিরোধী দলের কড়া সমালোচনা করেছেন সময়ে সময়ে। দিয়েছেন মূল্যবান পরামর্শ। এতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সব মানুষের কাছে প্রিয় এক মানুষ হিসেবে।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে বুধবার সকালে পারিবারিক বৈঠকের পর তার দাফনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। সর্ব সাধারণের শ্রদ্ধা জানাতে তার লাশ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারেও নেয়া হবে বলে জানানো হয়েছে।
১৯৪১ সালের ২৭শে ডিসেম্বর চট্টগ্রামের রাউজানে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ও পৈত্রিক নিবাস। বড় হয়েছেন ঢাকায়। পিতামাতার দশ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। পড়াশোনা করেছেন বকশীবাজার স্কুল, ঢাকা কলেজ ও ঢাকা মেডিকেলে। ছাত্র ইউনিয়নের মেডিকেল শাখার সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ছাত্র অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুর্নীতির বিরুদ্ধে করেছিলেন সংবাদ সম্মেলন।

১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ও ১৯৬৭ সালে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে জেনারেল ও ভাস্কুলার সার্জারিতে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। কিন্তু চূড়ান্ত পর্ব শেষ না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশে ফিরে আসেন। বৃটেনে প্রথম বাংলাদেশি সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিডিএমএ)’র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক তিনি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা জাফরুল্লাহ চৌধুরী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম জিএস ডা. এমএ মবিনকে নিয়ে আগরতলার বিশ্রামগঞ্জের মেলাঘরে হাবুল ব্যানার্জির আনারস বাগানে গড়ে তোলেন প্রথম ফিল্ড হাসপাতাল- ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’। হাসপাতালটির কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ডা. সিতারা বেগম বীরপ্রতীক। সেসময় প্রশিক্ষিত নার্স না থাকায় নারী স্বেচ্ছাসেবীদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সে হাসপাতালের দুই স্বেচ্ছাসেবী ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল ও তার বোন সাঈদা কামাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতাল।

বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি অনেক সম্মাননা ও অর্জন করেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ফিলিপাইন থেকে র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারে ভুষিত হন ১৯৮৫ সালে।  সুইডেন থেকে বিকল্প নোবেল হিসাবে পরিচিত রাইট লাভলিহুড পুরস্কার পান ১৯৯২ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ (২০০২) এবং মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করেন তিনি। ২০২১ সালে আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার পান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন বর্ণাঢ্য এক জীবনের অধিকারী। স্বাধীন  দেশে তিনি হতে পারতেন দেশসেরা সার্জন। কিন্তু লড়াকু মানুষ ডা. জাফরুল্লাহ স্বাধীন দেশে নিজেকে নিয়োজিত করেন গণমানুষের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের করেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকর্মী। প্রথম উদ্যোগ নেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের। জনকল্যাণধর্মী চিকিৎসানীতির মাধ্যমে দেশে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার নীতি প্রণয়ন, জাতীয় শিক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে অগ্রসর শিক্ষা নীতি প্রণয়ন ও নারী উন্নয়নে রাখেন যুগান্তকারী ভূমিকা। সরকার ও রাষ্ট্রের, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছেন বুকচিতিয়ে। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত, অনিশ্চিত হতো তখনই বিবদমান পক্ষের মাঝখানে সমঝোতার সেতুর ভূমিকা নিতেন এই বীর যোদ্ধা।  রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থেকে একজন ব্যক্তিমানুষের পক্ষে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য যতটুকু কাজ করা সম্ভব তার পুরোটাই করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়া এই বীর সেনানী সময়ে সময়ে অপমান অবজ্ঞারও শিকার হয়েছেন। কিন্তু তাতে  থেমে যায়নি তার বিবেকের কণ্ঠ। কঠিন পণ নিয়ে দাঁড়িয়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
ছাত্রজীবনে চড়তেন দামি গাড়িতে। ছিল পাইলটের লাইসেন্স। লন্ডনে পড়াশোনা অবস্থায় রাজকীয় দর্জি তার বাসায় এসে মাপ নিয়ে স্যুট তৈরি করে দিতেন।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বাংলাদেশে ফেরার গল্পটি কিংবদন্তী তূল্য এক ইতিহাস। পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মমতার প্রতিবাদে লন্ডনের হাইড পার্কে যে কয়েকজন বাঙালি পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুন ধরে রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকে পরিণত হয়েছিলেন তাদের একজন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তারপর বৃটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে ‘রাষ্ট্রবিহীন নাগরিকের’ প্রত্যয়নপত্র নিয়ে সংগ্রহ করেন ভারতীয় ভিসা। ভারতে গিয়ে সেখানে গড়ে তুলেন ফিল্ড হাসপাতাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতাল। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে বহনকারী যে হেলিকপ্টারটি হামলার শিকার হয়েছিল তাতে অন্যদের মধ্যে ছিলেন- ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গ্রামে ফিরে গিয়ে স্বাস্থ্যযুদ্ধ শুরু করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের ফিল্ড হাসপাতালটি গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র নামে গড়ে তুলেন কুমিল্লায়। পরে সেটা স্থানান্তর করেন ঢাকার অদূরে সাভারে। এ ‘গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র’ নামটি দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কেন্দ্রের ভবিষ্যৎ কর্মকা-ের জন্য বরাদ্দ দিয়েছিলেন প্রায় ৩১ একর জমি।

স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠনের লক্ষ্যে প্রথম বৈঠকটিতে সভাপতিত্ব করেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। পরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রধান ছিলেন তিনি। ‘সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ ছিল এদেশের মধ্যবিত্তের মৌলিক একটি প্রকাশনা। সর্বোচ্চ প্রচারণা ছিল বিচিত্রার প্রধান হাতিয়ার। সত্তর দশকের বিচিত্রায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানী প্রমুখ ছাড়া হাতেগোনা যে ক’জন বিচিত্রার প্রচ্ছদে স্থান পেয়েছিলেন- ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী তাদের একজন।
১৯৭৯ সাল থেকেই তিনি জাতীয় শিক্ষা কমিটির ও নারী কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বাংলাদেশে শিক্ষা ও নারী নীতি প্রণয়নে। তবে গণস্বাস্থ্যের পর তার বড় কীর্তি হচ্ছে ১৯৮২ সালের জাতীয় ঔষুধ নীতি। স্বাধীনতার পর স্বাস্থ্যখাতে যেটাকে বিবেচনা করা সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হিসেবে। তার প্রচেষ্টায় আমদানি ওষুধের সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ২২৫ এ। ওই নীতির সূত্র ধরেই দেশ এখন ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ।  বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে একটি ওষুধ রপ্তানিকারক দেশে। অথচ জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ১৯৯২ সালে তার সদস্যপদ বাতিল করেছিল বিএমএ। বিনা বিচারে তার ফাঁসি চেয়ে পোস্টারও সাঁটানো হয়েছিল।
স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের সময়ে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে  দেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। কিন্তু অনুপ্রাণিত করেছেন বহু ভালো পদক্ষেপ গ্রহণে।