ঢাকাসোমবার , ১৫ মে ২০২৩
  • অন্যান্য

যে কারণে মোখার আঘাত মিয়ানমারে

অনলাইন ডেস্ক
মে ১৫, ২০২৩ ১১:১৩ পূর্বাহ্ণ । ৮৩ জন
ছবি: সংগৃহীত

শেষ পর্যন্ত ‘অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়’রূপে মোখা মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করেছে। দেশটির উত্তর-পশ্চিম উপকূলের রাখাইন রাজ্যের সিত্তওয়ে শহরের কাছ দিয়ে এটি স্থলভাগে ওঠে। এ সময় বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ২০৯ কিলোমিটার ছিল বলে জানায় মিয়ানমারের আবহাওয়া বিভাগ। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মডেলে মোখার গতিপথ দেখানো হয়েছিল সেন্টমার্টিনের হয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের সীমানা নির্ধারক নদী নাফ। কিন্তু এটি মূলত চার কারণে সেন্টমার্টিনেরও অন্তত ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণ দিক দিয়ে মিয়ানমারে চলে যায়। কারণগুলো হচ্ছে-পশ্চিমা বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা, ভূপৃষ্ঠ থেকে ঊর্ধ্বমুখী (আকাশ) বায়ুর চাপ এবং ‘সাইক্লোন হিট পটেনশিয়াল’। এগুলো বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ছিল। সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের ডান দিকে এবং পেছনে বাতাসের চাপ সবসময় বেশি থাকে। কিন্তু বাম দিকে থাকা সেন্টমার্টিনেও ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এটি। বেলা আড়াইটার দিকে সেন্টমার্টিনে সর্বোচ্চ ১৪৭ কিলোমিটার গতির ঝড়ো হাওয়া রেকর্ড করা হয়েছে। এটিই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে মোখার সর্বোচ্চ মাত্রার ছোবল। এ ছাড়া টেকনাফে ১১৫ কিলোমিটার ঝড়ো হাওয়ার দাপট চলে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আবহাওয়া সংস্থার প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বিএমডি যুগ্ম পরিচালক আসাদুর রহমান বলেন, বিকাল ৩টার দিকে এটি উপকূল অতিক্রম করতে থাকে। ৩ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে দাপিয়ে সন্ধ্যা নাগাদ মিয়ানমারের সিত্তওয়ে উপকূল পার হয়। সাধারণত ঘূর্ণিঝড় প্রথমে ব্যাপক বৃষ্টি ঝরিয়ে প্রথমে স্থল নিম্নচাপ ও লঘুচাপের পর্যায় পার করে। মোখার প্রভাবে আগামীকাল পর্যন্ত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের সব জেলা এবং বরিশাল, ঢাকা ও সিলেট বিভাগের কিছু এলাকায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হবে।

আবহাওয়াবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক জানান, চার কারণে মোখা সুপার সাইক্লোন হয়নি এবং বাংলাদেশে আঘাত করেনি। গত কয়েক দিন মানুষ যে দাবদাহ ভোগ করেছে, সেটির সুফলই পেয়েছে বাংলাদেশ। পশ্চিমা লঘুচাপের প্রভাবে বাংলাদেশের ওপর পূর্ব দিকে যে বায়ুচাপ ছিল সেটি ঘূর্ণিঝড়কে দক্ষিণ দিকে ঠেলে দেয়। ফলে দাবদাহ আশীর্বাদরূপে কাজ করেছে। না হলে মোখা সুপার সাইক্লোন আকারে এবং বাংলাদেশের দিকেই চলে আসতে পারত। কেননা, মোখা সাগরে থাকাকালে ‘সুপার সাইক্লোন’ রূপ ধারণ করার অবস্থায় ছিল। শনিবার মধ্যরাতের দিকে ২১৫ কিলোমিটার ঝড়ো হাওয়া রেকর্ড করা হয়, যা আর ৫ মিটার বাড়লেই ‘সুপার সাইক্লোনে’ রূপ নিত। কিন্তু পশ্চিমা বায়ুপ্রবাহ, সমুদ্রপৃষ্ঠের বা পানির তাপমাত্রা, ভূপৃষ্ঠ থেকে ঊর্ধ্বমুখী (আকাশ) বায়ুর চাপ এবং ঘূর্ণিঝড়ের তাপীয় বিভব মাত্রা বা ‘সাইক্লোন হিট পটেনশিয়াল’ ইতিবাচক হয় বাংলাদেশের জন্য। কেননা, মোখার জন্য এই চারটির কোনোটিই অনুকূল ছিল না। পশ্চিমা বায়ুর প্রাধান্য ছিল বাংলাদেশ উপকূল থেকে দূরে সাগরে ৩০ ডিগ্রি অক্ষাংশ পর্যন্ত। আকাশের দিকে প্রায় ৯ কিলোমিটার পর্যন্ত ছিল এর বিস্তার। এটি ‘স্টিয়ারিং উইন্ড’ বা চালক বায়ু হিসাবে ছিল। মূলত এটিই ঘূর্ণিঝড়টিকে বাংলাদেশ উপকূল থেকে ঠেলে গভীর সাগরের দিকে রাখে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সাগরের পানির তাপমাত্রা, যা ছিল মাত্র ৩০-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সাইক্লোন হিট পটেনশিয়াল ৬০-৭০ জুল। এ ছাড়া ঊর্ধ্ব-নিম্ন আকাশের বায়ুচাপের পার্থক্য কম ছিল। এটি কক্সবাজার-মিয়ানমুখী থাকায় ঘূর্ণিঝড়টির গতিপথ সেদিকে ছিল।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান মোখা পরিস্থিতি নিয়ে দুপুর ১২টার দিকে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করেন। এ সময় তিনি বলেন, মোখায় যে ধরনের আশঙ্কা করা হয়েছিল তা হয়নি। আল্লাহর রহমতে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে না। সকাল ৬টার দিকে এই ঝড়ের অগ্রভাগ আঘাত হেনেছে। কিন্তু ওই সময় ভাটা ছিল। ফলে জলোচ্ছ্বাস হয়নি। তিনি আরও বলেন, এবার দুর্যোগ পূর্ববর্তী প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভালো। প্রায় সাত লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছে। তিনি জানান, সরকার ২০ লাখ টাকা নগদ বরাদ্দ দিয়েছে দুর্গতদের প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তার লক্ষ্যে। এ ছাড়া ২০০ মেট্রিক টন চাল, ১৪ মেট্রিক টন ড্রাই কেক এবং টোস্ট দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি খাবার স্যালাইন এবং মেডিকেল টিমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী সময়ে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ করে পুনর্বাসন কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।

মোখা সম্পর্কে রোববার বিকালে ২১ নম্বর বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জারি করে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি)। এতে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় মোখা বাংলাদেশ উপকূল সরে গিয়ে উত্তর-উত্তরপূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে সামান্য দুর্বল হয়েছে। রোববার বিকাল ৩টায় কক্সবাজার ও উত্তর-মিয়ানমার উপকূল অতিক্রম করা শুরু করে। সম্পূর্ণ ঝড়টি সন্ধ্যা নাগাদ উপকূল অতিক্রম সম্পন্ন করে এবং পরে আরও দুর্বল হতে পারে।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ঘূর্ণিঝড়টির প্রভাবে উত্তর-পূর্ব বঙ্গোপসাগর ও এর কাছাকাছি এলাকায় বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত বেড়েছিল। তখন কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি ছিল। আর চট্টগ্রাম ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়। পাশাপাশি মোংলা সমুদ্রবন্দরে ৪ নম্বর স্থানীয় হুঁশিয়ারি সংকেত ছিল।

উপকূলীয় জেলাগুলোও বিভিন্ন ধরনের সংকেতের অধীনে ছিল। এর মধ্যে উপকূলীয় জেলা চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা এবং এসব জেলার কাছের দ্বীপ ও চরগুলো ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় ছিল। আর ১০ নম্বর বিপদ সংকেতে ছিল কক্সবাজারের কাছাকাছি দ্বীপগুলো। যুগান্তর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এসব জেলার দ্বীপগুলো কমবেশি ঝড়ের কবলে পড়ে। তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ে সেন্টমার্টিন, শাহপরী, কুতুবদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপ। বিশেষ করে সেন্টমার্টিন আর শাহপরীর দ্বীপ লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। এর বাইরে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরগুনা জেলার নদীবন্দরসমূহে ৪ নম্বর নৌ মহাবিপদ সংকেত ছিল। এই অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রবর্তী অংশ ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরসমূহের নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫-৭ ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার কথা ছিল। তবে ঠিক কত ফুট জলোচ্ছ্বাস হয়েছে তা সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত জানাতে পারেনি বিএমডি। এদিকে মোখার প্রভাবে আগামীকাল পর্যন্ত গোটা কক্সবাজারসহ গোটা চট্টগ্রাম বিভাগে এবং ঢাকা, সিলেট ও বরিশাল বিভাগের কিছু জেলায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টি হতে পারে। সাধারণত ২৪ ঘণ্টায় ৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার বৃষ্টিকে ভারী আর ৮৯ মিলিমিটার বা তার বেশি বৃষ্টিকে অতি ভারী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। এ ছাড়া ভূমি বা পাহাড় ধসের আশঙ্কাও আছে। অতি ভারী বর্ষণের প্রভাবে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলের কোথাও কোথাও এই ভূমিধস হতে পারে।