ঢাকাশনিবার , ১৬ মার্চ ২০২৪
  • অন্যান্য

দ্রব্যমূল্যের চাপে আওয়ামী লীগ

অনলাইন ডেস্ক
মার্চ ১৬, ২০২৪ ১২:১৪ অপরাহ্ণ । ২১ জন

সরকারবিরোধীদের আন্দোলন-কর্মসূচির চেয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে বেশি চাপে আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনশীল রাখাকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করছে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল। এর পরও বাজার কারসাজি করে ভোক্তাদের পকেট কেটে অতি মুনাফা লাভের পথ ছাড়ছেন না অসাধু ব্যবসায়ীরা। এমন পরিস্থিতিতে বিব্রত ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের নীতিনির্ধারকরা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক সূত্র জানায়, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক নানা চাপ এরই মধ্যে সামলে নিয়েছে সরকার ও আওয়ামী লীগ। এ বিষয়ে এখন অনেকটাই নির্ভার ক্ষমতাসীনরা। তাদের এখন মূল চ্যালেঞ্জ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। জিনিসপত্রের দাম লাগামহীন বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে।
দলের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতার মতে, আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনী ইশতেহারে বড় অঙ্গীকার ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখা। সরকারের সামনে এখন এটিই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। ডলারের দাম, বৈশ্বিক সংকটের সঙ্গে যোগ হয়েছে এ দেশের অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারসাজি। এগুলো মোকাবেলা করে বাজার স্বাভাবিক রাখা দুঃসাধ্য একটি কাজ।
জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের হাতে কোনো জাদুর কাঠি নেই। আমরা চেষ্টা করি। কিন্তু সব চেষ্টা কি সব সময় সফল হয়?’

দলের একাধিক সূত্র জানায়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তৃণমূলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। সামনে স্থানীয় সরকারের উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। সম্ভাব্য প্রার্থীরা এরই মধ্যে মাঠে জনসংযোগ করছেন।
তাঁদের মানুষের নানা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সামনে পড়তে হচ্ছে। তাঁরা কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রীদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছেন যেভাবে হোক জিনিসপত্রের দাম কম রাখার ব্যবস্থা করতে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সারা মুসলিম দুনিয়ায় ব্যবসায়ীরা রমজানে দাম কমান, যাতে মানুষ কষ্ট না পায়। আর আমাদের অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ান। এঁদের দেশপ্রেম, নাগরিকদের প্রতি দায়িত্ববোধ নেই। ব্যবসায়ীরা মুনাফা করবেন কিন্তু এঁরা অতিলোভী। এঁরা দানবে পরিণত হয়েছেন। এঁদের আইনের আওতায় আনতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এঁদের বিরুদ্ধে জনমত গড়তে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।’দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠনের পরপরই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। নতুন সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি রোধে নিজের কঠোর অবস্থানের কথা জানান। এ বিষয়ে জোরালো ভূমিকা রাখতে মন্ত্রিসভার সদস্যদের প্রতি নির্দেশনা দেন। এর পরই একাধিক মন্ত্রণালয় এবং মাঠ প্রশাসন এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ শুরু করে।

সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, এবার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে জিনিসপত্রের দাম মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার অঙ্গীকার করা হয়। নতুন সরকার গঠনের পরই এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ শুরু হয়। তখন থেকেই বাজার নজরদারি, মিল ও গুদাম পরিদর্শন, খোলা বাজারে অভিযান, মজুদদারদের বিরুদ্ধে অভিযানসহ নানা কর্মপরিকল্পনা নিয়ে মাঠে তৎপরতা শুরু হয়। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। কমানো হয় একাধিক পণ্যের আমদানি শুল্ক। বড় ব্যবসায়ীদের রমজানে মূল্যহ্রাসের পরামর্শ দেয় সরকার।

গত ১০ মার্চ থেকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ঢাকার ৩০টি স্থানে কম মূল্যে গরু, খাসি ও মুরগির মাংস, দুধ এবং ডিম বিক্রি শুরু করে। ঈদের আগের দিন পর্যন্ত এটি অব্যাহত থাকবে। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার বেশ কয়েকটি স্থানে কম দামে মাছ বিক্রি করছে মৎস্য অধিদপ্তর।

রমজানে নিম্ন আয়ের মানুষকে কিছুটা স্বস্তি দিতে ভর্তুকি মূল্যে চাল, ডাল, তেল, লবণসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে সারা দেশে এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীকে রমজান মাসে দুইবার ভর্তুকি মূল্যে পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে।

সরকারের নানা পদক্ষেপের পরও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানো থেমে নেই। রমজান শুরুর পর প্রায় সব পণ্যের দামই কমবেশি বেড়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর খোলা বাজারগুলোতে চালের দাম কেজি প্রতি দুই টাকা করে বেড়েছে। রমজানের আগে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল চালের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। এর পরও ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে গতকাল চালের দাম বেড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি খেজুরের আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে খেজুরের দামও বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু এর পরও বাজারে কমেনি খেজুরের দাম। বেঁধে দেওয়া দামের চেয়ে অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে খেজুর।

রাজধানীর বিভিন্ন খোলা বাজার ঘুরে দেখা যায়, সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করছেন না বিক্রেতারা। সব পণ্যই নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। মাছ, মাংস, ডাল, তেলসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে রমজান শুরুর পর। এ নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। সিন্ডিকেটগুলোতে সব দলের ব্যবসায়ীরা আছেন। তাঁরা সব সময় নানা কৌশল করে দাম বাড়ানোর চেষ্টায় থাকেন। এ কাজে সব দলের ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধ।’

সম্প্রতি গণভবনে এক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার কারসাজির নিয়ে ক্ষোভ জানান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যাঁরা বাজার কারসাজি করেন তাঁদের গণধোলাই দেওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

সাধারণ সম্পাদক যা বললেন

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এখন রমজান মাসে সরকারকে বিব্রত করার জন্য সিন্ডিকেট থাকতে পারে। খতিয়ে দেখতে হবে যে এ ধরনের অপকর্মের সঙ্গে বিএনপির সম্পৃক্ততা আছে কি না। তারাই এসব সিন্ডিকেট করে সরকারকে বিব্রত ও নির্বাচিত সরকারের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করার অপচেষ্টা চালাতে পারে।’

টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকেও আওয়ামী লীগ সরকার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে সরকার ব্যর্থ নাকি জিম্মি—এমন প্রশ্নের উত্তরে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ব্যর্থও না, জিম্মিও না। দেশটা অনেকের চেয়ে ভালো চলছে। আজকে সারা বিশ্বে যে টালমাটাল অবস্থা। সারা বিশ্বে এই সমস্যা চলছে। বাংলাদেশ কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয় যে আমরা আপনাদের খুব সুখে শান্তিতে রাখতে পারব। অন্যরা ভালো নেই আমরাও ভালো নেই।  সবাই একযোগে ভালো থাকার চেষ্টা আন্তর্জাতিকভাবেও চলছে।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, চলমান বৈশ্বিক যে পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক সংকট সারা বিশ্বে আজকে যে অস্থিরতা চলছে তার প্রভাব প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশেও পড়বে। কথা হচ্ছে সরকার বিষয়টিকে কিভাবে মোকাবেলা করছে। শেখ হাসিনা ক্রাইসিস ম্যানেজার হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালন করছেন। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণেও তিনি বিভিন্নভাবে প্রয়াস অব্যাহত রেখেছেন।