চলমান রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে অর্থবহ সংলাপই শেষ ভরসা বলে মনে করছেন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজসহ দেশের বিশিষ্টজনরা। তাদের মতে, সব দলের অংশগ্রহণে আগামী দিনে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে আলোচনার টেবিলে বসা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। আর এ উদ্যোগ ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের তরফ থেকেই নিতে হবে। এক্ষেত্রে ‘শর্ত’ জুড়ে দিলে এই সংলাপ দিনশেষে অর্থহীনই হবে। এতে পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় হয়ে ওঠার আশঙ্কা থাকবে।
বাংলাদেশে একটি বিশ্বাসযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও সহিংসতামুক্ত জাতীয় নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে অর্থবহ সংলাপে বসতে বলেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দল। ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (এনডিআই) এবং ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউটের (আইআরআই) সমন্বয়ে গঠিত এ প্রতিনিধিদলের সদস্যরা গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকার, রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশনসহ অংশীজনদের পাঁচটি সুপারিশ করেন তারা। এর মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অর্থবহ সংলাপের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিভিন্ন সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, মাঠের বিরোধী দল বিএনপি, জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধীদল জাতীয় পার্টিসহ নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলও সংকট সমাধানে সংলাপে বসার তাগিদ দিয়েছে। নির্বাচন কমিশনও দুই বড় দলকে আলোচনার টেবিলে বসার অনুরোধ জানিয়েছে। কেউ শর্ত জুড়ে দিয়ে আবার কেউ শর্ত ছাড়াই একটেবিলে বসার পরামর্শ দিয়েছে আওয়ীমী লীগ ও বিএনপিকে।
পাশাপাশি প্রভাবশালী বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর প্রতিনিধিরাও নির্বাচন সামনে রেখে চলমান সংকট আরও প্রকট হওয়ার আগেই সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের পথে হাঁটার জন্য দুই বড় দলকে একটেবিলে বসতে বলেছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে-দুই বড় দলই চলছে উলটো পথে। তারা যার যার অবস্থানে অনড়, কেউ কাউকে ছাড় দিতেও নারাজ।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন সোমবার যুগান্তরকে বলেন, পরিস্থিতি ক্রমেই যেদিকে যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে সামধান না হলে দেশের পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠবে। এক দল গায়ের জোরে নির্বাচন করিয়ে নিতে চাইবে, আরেক দল যে কোনো মূল্যে তা প্রতিহত করতে চাইবে। ফলে নির্বাচনের আগে সহিংস হয়ে উঠবে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সংলাপই একমাত্র সমাধান। আন্তরিকতা নিয়ে একটেবিলে আলোচনার জন্য বসলে যে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে-ক্ষমতাসীনদের মধ্যে সেই আন্তরিকতা আছে কি না। নাকি তারা অতীতের মতোই আগামী দিনেও একটি একতরফা নির্বাচন করতে চায়। দিনের ভোট রাতেই করতে চায়।
মূলত নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা নিয়েই চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি দিনদিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে। সংবিধান অনুযায়ী, ১ নভেম্বর থেকে ২৯ জানুয়ারির মধ্যে সংসদ নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
২২ নভেম্বর বসবে একাদশ জাতীয় সংসদের শেষ অধিবেশন। ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এই অধিবেশন চলার কথা। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠন করা হবে নির্বাচনকালীন সরকার। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী এই সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
বিএনপিসহ তাদের শরিক ও সমমনা অন্যান্য রাজনৈতিক দল চাইছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কিন্তু এ প্রশ্নে কোনো ছাড় দিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। এরকম একটি পরিস্থিতিতে দুই পক্ষই পালটাপালটি কর্মসূচি দিয়ে কার্যত রাজপথে শক্তি প্রদর্শনের দিকেই এগোচ্ছে।
এ মুহূর্তে তারা নিজ নিজ অবস্থানের সমর্থনে শক্তি দেখিয়ে মাঠের রাজনীতিতে জিততে চাইছে। ফলে ভোটের আগেই সংঘাতের আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, বিশিষ্টজনসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা। তাদের মতে, দুই বড় দল সংলাপে বসতে না পারলে এবং নির্বাচন প্রশ্নে কাঙ্ক্ষিত সমাধানে পৌঁছাতে না পারলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দলের ‘অর্থবহ সংলাপে বসতে’ বলার বিষয়টিকে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ইতিবাচক হিসাবে নিয়েছে। দুই দলেরই নেতাদের অনেকে সংঘাত এড়াতে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন; কিন্তু তারাও নিজেদের দলীয় অবস্থানের পক্ষে অনড় থেকে পরস্পরের ওপর চাপ সৃষ্টির ‘একরোখার’ কৌশলকে সমর্থন করছেন। এর ফলে সুশীল সমাজসহ বিশিষ্টজনদের অনেকেই মনে করেন, দুই পক্ষই এখন চরম পর্যায়ের দিকে এগোচ্ছে এবং সংলাপের সুযোগ কমে যাচ্ছে। দিনদিন একতরফা নির্বাচনের প্রস্তুতিই দৃশ্যমান হচ্ছে। এ কারণে সংঘাতের আশঙ্কাটাও বাড়ছে।
বড় দলের এই বিপরীতমুখী অবস্থান সত্ত্বেও আলোচনার টেবিলে বসে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান চায় জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান ও জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি বলেন, আমরা সব সময় বলেছি, বহুবার বলেছি, আলোচনায় বসে সংকটের সমাধান বের করা জরুরি। আমরা মনে করি, অবশ্যই সংলাপের প্রয়োজন আছে। তবে দুই প্রধান দল যেভাবে যার যার অবস্থানে অনড় তাতে আমার মনে হয়, সংলাপে বসলেও কোনো সুফল মিলবে না।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান এমপি এ প্রসঙ্গে সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এটা ঠিক, রাজনৈতিক সংকট সমাধানে রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের একটেবিলে বসা উচিত। আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান বের করা উচিত। কিন্তু বিএনপি তো আলোচনা চায় বলে মনে হয় না। আলোচনা চাইলে তারা শর্ত জুড়ে দিত না। আর কোথাও কখনো শর্ত দিয়ে আলোচনা হয় না।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের মূল দাবি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন। সরকার যদি একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার গঠনে সংলাপ চায়, তাহলেই আমরা আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। আমরা বরাবরই বলে এসেছি, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে আলোচনা হতে পারে না।
বিশিষ্ট আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক সোমবার যুগান্তরকে বলেন, আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যার সমাধান জরুরি। এক্ষেত্রে সব পক্ষকেই আন্তরিক হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দল এটাই বলেছে। তিনি বলেন, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই। রাজনৈতিক দল মানেই সভাপতি বা সভানেত্রীকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান।
আর পশ্চিমারা যারা এসেছিলেন, তারা গণতন্ত্র বলতে বোঝেন সংলাপ, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা প্রভৃতি। আমার মনে হয়, তারা (যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক-নির্বাচনি পর্যবেক্ষক দল) বলতে চেয়েছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে তোমাদের এগুলো করতে হবে। ভবিষ্যতে আমাদের দেশের কোনো সংকটে তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) সাহায্যের প্রয়োজন পড়তে পারে। এখন যদি আমরা তাদের এসব সুপারিশ আমলে না নিই, তখন তারা আমাদের সাহায্যের আবেদন আমলে নাও নিতে পারে। তাই সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার বিকল্প নেই।
জানতে চাইলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়, তা নিয়ে আলোচনা দরকার। এটা জনগণের দাবি। সুতরাং এ দাবি মেনে নিয়েই সরকার আলোচনার উদ্যোগ নেবে-এমনটাই প্রত্যাশা করি।
যদিও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এর আগে নানা দফায় সংলাপে বসলেও এর ফলাফল খুব একটা ইতিবাচক কখনো পাওয়া যায়নি। কখনো তারা নিজেরা আলোচনার টেবিলে বসেছে, কখনো তারা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে আলোচনায় বসেছে, দিনশেষে ফল আশানুরূপ হয়নি। এক-এগারোর জরুরি অবস্থার আগে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুল জলিল এবং বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া ওই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দফায় দফায় বৈঠক করেন। সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠক শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হয়নি।
এরও আগে ১৯৯৪ সালের শেষদিকে কমনওয়েলথ মহাসচিবের প্রতিনিধি স্যার নিনিয়ান স্টেফানের মধ্যস্থতায় এবং পরে ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের প্রতিনিধি অস্কার ফার্নান্দেজের মধ্যস্থতায় আলোচনার টেবিলে বসেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতারা। এ আলোচনারও সুফল পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে খোদ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেই বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সংলাপে বসেন। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার আশ্বাস দেন তিনি। যদিও পরবর্তী সময়ে বিরোধীরা ওই নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম, কারচুপি, এমনকি দিনের ভোট রাতেই করার অভিযোগ আনেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার সোমবার যুগান্তরকে বলেন, দেশের গণতান্ত্রিক ভিত শক্ত করতে হলে, সরকারবিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ বা আলাপ-আলোচনা করে এর সমাধান করা উচিত। কারণ, সংলাপ ছাড়া এ দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করা যায় না। আলোচনা ছাড়া দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নও সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, তবে এটা ঠিক, অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, দুই বড় দল নিজেরা আলোচনায় বসে সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। বরং তারা একসঙ্গে বসে মারামারি করবে। তাই সংলাপে তৃতীয় পক্ষকে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে রাখা প্রয়োজন। অতীতেও এরকম বিদেশি মধ্যস্থতাকারীদের উপস্থিতিতে সংলাপে বসার নজির রয়েছে, তাই এটা নতুন কিছু না।